সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন করে শপথ নেওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় অর্জনের দিন ২৬ মার্চ। পরাধীনতার শিকল ভাঙার দিন।

শুক্রবার (২৬ মার্চ) মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে এ কথা বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ২৬ মার্চ। আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হলো আজ। মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমি দেশের সকল নাগরিক ও প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশের নাগরিকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অবিসংবাদিত নেতৃত্বে আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা। শ্রদ্ধা জানাই জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনকে। সম্মান জানাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। যারা স্বজন হারিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন তাদের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা। কৃতজ্ঞতা জানাই সকল বন্ধুরাষ্ট্র, সংগঠন ও ব্যক্তির প্রতি, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আর ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ সময়কে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে জনসমাগম এড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালা উদযাপন করা হবে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়ন এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয় ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাংলার মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। তিনি বাঙালি জাতিকে শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশ দেন।

শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে অতর্কিতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা করে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও তৎকালীন ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই ঘোষণা প্রচারিত হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রী করে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে আমাদের যা কিছু অর্জন তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের হাত ধরেই অর্জিত হয়েছে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেললাইন, পোর্ট সচল করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেন। ১৯৭৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ অতিক্রম করে। ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র ১০ মাসে তার নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয়। মাত্র সাড়ে ৩ বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তিনি স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যান। সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন একটি শোষণ-বঞ্চণামুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে তাকে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর থেমে যায় বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা। হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ঘেরাটোপে আটকা পড়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। ঘাতক ও তাদের দোসররা ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করতে জারি করে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’।

তিনি বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। আমরা দায়িত্ব নিয়েই বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে গরিব, প্রান্তিক মানুষদের সরকারি ভাতার আওতায় আনা হয়। কৃষি উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করি। পানির হিস্যা আদায়ে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন করি। ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু করি।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আজ জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়ন করছি। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দারিদ্র্যের হার গত ১২ বছরে ৪২.৫ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বিশাল এলাকার ওপর আমাদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের মানবেতর জীবনের অবসান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি গ্লানিমুক্ত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রয়েছে এবং বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা ২০২১-২০৪১ মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আমরাই বিশ্বে প্রথম শত বছরের ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়ন শুরু করেছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে।

তিনি বলেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সব গৃহহীনকে ঘর প্রদান কর্মসূচির আওতায় এনে ৮ লাখ ৯২ হাজার গৃহহীনকে ঘর প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৭০ হাজার ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ৫০ হাজার গৃহ নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪৬ পরিবারকে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে শহরের নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এখন পর্যন্ত আমরা ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি, যা মোট জিডিপির ৪.৪৪ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ। এই অর্জনকে অর্থবহ করতে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে, মহান স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মর্যাদাশীল উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। এটা আমাদের জন্য এক বিশাল অর্জন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বীর বাঙালি মাত্র নয় মাসে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনশাআল্লাহ।

তিনি বলেন, আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা শপথ নিই- মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top