মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের উপযুক্ত সময় এখনো আসেনি

'মাদার অফ হিউম্যানিটি' খেতাবে ভূষিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই “মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখার” জন্য।  ২১শে মার্চ ২০১৮ তারিখে চট্টগ্রামের পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত জনসভায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্ব তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান জানান।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বিধায় তাদের অধিকার সবার আগে।  মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবাই সর্বাগ্রে অধিকার ভোগ করবে।  সে কারণে চাকরিতে আমরা কোটার ব্যবস্থা করেছি। 

কারণ তাদের আত্মত্যাগের কারণেই তো আজ এ চাকরির সুযোগ। আজ এ স্বাধীনতা। আজ মানুষের এ উন্নয়ন। যদি দেশ স্বাধীন না হতো কোনো উন্নয়ন হতো না। কারও কোনো চাকরিও হতো না। কোনো উচ্চ পদেও যেতে পারত না। এ কথা ভুললে চলবে না।

কোটা যদি পূরণ না হয়, তাহলে শূন্য পদে সাধারণ চাকরিপ্রার্থী মেধাবীদের নিয়োগ দিতে কোটার বিষয়টি শিথিল করা হয়েছে।”
 

কোটা নিয়ে সমালোচনা এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। আর এই কোটা সমালোচনা মানেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যত কথা।  আসলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কথা বলা সহজ।  কারণ, স্বাধীন এই বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা এখনো অধিকাংশই গরিব ও অবহেলিত। রাজনৈতিক নেতা আর বড় বড় প্রভাবশালী ব্যাক্তি অথবা মহলের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না।  কারণ, তাদের ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, তারা সহজেই প্রতিউত্তর দিতে পারে। তা ছাড়া ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে সময়ে সময়ে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষভাবে, জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এদের তৎপর হতে বেশি দেখা যায়। এই সব তৎপরতায় হয়তো লুকিয়ে থাকে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি। এই চক্রান্তে তারা জড়িয়ে নেয় কিছু চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ সমাজকে।

বর্তমানেও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের আত্মীয় স্বজনরাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য আন্দোলন করছে এবং চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ সমাজকে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে।

কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা?
মুক্তিযোদ্ধারা রিট করে স্বাধীনতা পায়নি। যুদ্ধ করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ঘরে এনেছে। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ তৈরি করেছে। তখন বাঙালি কোটা অত্যন্ত নগণ্য ছিল। কিন্তু আজ আমরা স্বাধীন বলে ১০০ ভাগ কোটা বাংলাদেশের মানুষের। অথচ, যারা যুদ্ধে অংশ নেননি, স্বাধীনতার পর তারা নিজেদের উন্নয়ন ঠিকই করেছে। নিজেদের এবং তাদের আত্মীয় স্বজনদের আর্থিক সচ্ছলতাও এনেছেন।

অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, আহত হয়েছেন। এমনকি দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যাওয়ার কারণে  ঐ সময় স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদররা নিজেরা এবং পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা, মা বোনদের ইজ্জত ও সম্ভ্রমহনী সহ অমানসিক অত্যাচার করেছে। ঐসময় মুক্তিযোদ্ধারা শারিরিক, সামাজিক এবং মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। 

মুক্তিযোদ্ধারা এখনো দেশের অনগ্রসর শ্রেণি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার নানা কষ্টে জীবনজাপন করছেন। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখা যায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে। সারাদিন দিনমুজুরের কাজ করেও নিজের এবং পরিবারের জন্য দুবেলা আহার জোগার করতে কষ্ট হয়। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে অনেক মুক্তিযোদ্ধা।
 

মুক্তিযোদ্ধাদের তৎকালীন অভিভাবক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, শ্রেষ্ঠত্ব ও সংগ্রামের কথা বিবেচনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কোটা চালু হয়।

 

বিসিএসে মেধা ও কোটা
যে ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে কাজ করার যোগ্যতা আছে, তাকেই বাংলাদেশ কর্মকমিশনের নিয়োগকর্তারা নিয়োগ করেন।  কোটা কখনো যোগ্যতার শর্তকে উপেক্ষা করতে পারে না।  কারণ, একজন কোটা প্রার্থীকে নির্দিষ্ট পদের জন্য সব যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে প্রিলিমিনারি, লিখিত, ভাইভা পাস করে চাকরি নিতে হয়।

যেহেতু কোটা আছে, সেহেতু অন্যদের তুলনায় কোটা প্রার্থীরা তাড়াতাড়ি চাকরি পায়।  কোটা ব্যবস্থায় অযোগ্যকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, কোটার কারণে যোগ্য ব্যক্তি চাকরি পাচ্ছে না, এগুলো আসলে যুক্তিহীন কথা।

বাংলাদেশের নিয়োগব্যবস্থায় কর্মদক্ষতায় কতটুকু জোর দেওয়া হয়, এটা সকলেরই জানা। বিসিএসে মেধা তালিকায় যিনি প্রথম হন, তাকে কেন আবার ট্রেনিং করতে হবে, যদি প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়াই মেধাবীর একমাত্র লক্ষণ হয়।  বিসিএস নিয়োগে কয়জন অভিজ্ঞ প্রার্থী নেওয়া হয়েছে?

মূলত সরকারি চাকরিতে প্রবেশে প্রশিক্ষণার্থীই নেওয়া হয়।  আসলে একজনের বিপরীতে দুই হাজার জন আবেদন করলে, প্রার্থী কমানোর জন্য প্রতিযোগিতা নেওয়া ছাড়া আর কি করার আছে।  তবে, নিয়োগের পরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবাইকে যোগ্য করে তোলা হয়।

আর এই সব প্রতিযোগিতায় বেশির ভাগ তারাই ভালো করে যাদের ব্যাকআপ ভালো, সুযোগ-সুবিধা ভালো পেয়েছে এবং রাজনৈতিক দলের প্রভাব আছে। মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বলে, তাদের কষ্ট করে প্রতিযোগিতায় টিকতে হয়।

আমি মনে করি, প্রকৃত মেধাবী তারাই যারা দেশের বাইরে বৃত্তি পেয়ে উচ্চতর ডিগ্রি করছে, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে পাশাপাশি দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। এই মেধাবীরা এবং যারা প্রবাসে অনেক কষ্ট করে দেশের আর্থিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখছে, এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা এরাই।

এই সব বিবেচনা এবং সংবিধানের ২৮ (৪) অনুচ্ছেদের আলোকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা যৌক্তিক। যত দিন মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর থাকবে, এই কোটার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।

কোথায় কোটা নেই?
পৃথিবীর সকল দেশেই কোটা ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশের সরকারি চাকরির সার্কুলারে উল্লেখ থাকে, প্রকৃত এবং স্থায়ী বাংলাদেশি নাগরিক। অর্থাৎ অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন কোনো বিদেশি নাগরিক এখানে আবেদন করতে পারবে না। এমনকি বাংলাদেশি কেউ বিদেশির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও আগে নাগরিকত্ব নিতে হবে এবং পরেও অনেক অনেক নিয়মকানুন আছে। 
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও রয়েছে নাগরিক ভিত্তিক কোটা যেমন বয়স কোটা, জেলা কোটা, নারী কোটা, উপজাতি কোটা, সামরিক সদস্যদের পোষ্য কোটা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্য কোটা, উপক‚লীয় কোটা, হাওর ও দ্বীপাঞ্চল কোটা।  ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে জিএসপি কোটা অর্থাৎ অর্থনৈতিক কোটা (যদিও এখন বন্ধ আছে)।

যোগ্যতাভিত্তিক কোটার মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞতা কোটা, নির্দিষ্ট বিষয়ের সার্টিফিকেট কোটা। আবার আছে কিছু অঘোষিত কোটা যেমন অর্থ কোটা, আত্মীয় কোটা, রাজনীতি কোটা, এলাকা কোটা, গ্র্যাজুয়েট কোটা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কোটা পর্যন্ত রয়েছে।  
এত এত কোটা থাকতেও কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা সবার চক্ষুশূল ? কারণ, একটাই গরিবের ভালো কেউই সহ্য করতে পারে না। বর্তমানে এই অপসংস্কৃতি আমাদের অনেক মাঝে স্থায়ীভাবে ঢুকে গেছে।

আমি মনে করি, কোটা ব্যবস্থা কখনো যোগ্যতার শর্তকে পাশ কেটে যায় না। এটি যোগ্যতার বিকল্পও না। আবার কোটা সারা জীবন চালু থাকতে হবে, তাও না। প্রয়োজনে সামান্য পরিমাণে হলেও কোটা সংস্কার করা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিসিএসসহ সরকারি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের সময় আসেনি। অনগ্রসর এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা, সুযোগ আর সমতা বাড়াতে পারলে এবং দেশকে আরও উন্নত করতে পারলে কোটার প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।

আর দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বেকার ভাতা চালু করা হলে, এই কোটা নিয়ে সমালোচনার আর নাও হতে পারে। সমালোচনার জন্য অনেক অনেক উপাদান আছে যেমন প্রশ্নপত্র ফাঁস, ঘুষ, দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি। দুর্নীতি দূর করতে পারলে কোটা নিয়ে আর সমস্যা হওয়ার কথা না। মেধাবীরা এই সব বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে দেশের উন্নয়নে অংশ নিবে, এটাই সবার কাম্য।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, সাংবাদিক।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top