বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ব্যাংকিং সেক্টরে একটি সাফল্যের খতিয়ান

ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট পরিচালিত একটি ব্যাংক, যার জন্ম ১৯৯৯ সনে। বাংলাদেশের প্রায় ৬০টি সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ট্রাষ্ট ব্যাংককে দ্বিতীয় প্রজন্ম ( সেকেন্ড জেনারেশন ) ব্যাংক এর কাতারে ফেলা হয়।

গত মার্চ ২০২২ সনে নিজ ফেইসবুক ওয়ালে একটি ক্যাপশন দিয়ে স্ট্যাটাস দেই জনমত সংগ্রহের জন্য। ক্যাপশনটা ছিল নিম্মরুপ।

” বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব লোকসানী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী দ্বারা পরিচালনার সিদ্ধান্ত কি সঠিক বা ভূল? “

এর প্রথম পর্বে আলোকপাত করেছিলাম বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম ডকইয়ার্ড Dockyard Engineering & Works (DEW) উপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন যা গত ১১ই মার্চ ২০২২ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে আমি গত পাঁচ বছর উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্স শীট হতে আয় ব্যায়, সরকারকে রাজস্ব প্রদান, করোনাকালীন সময় দূর্যোগ মোকাবিলায় নৌবাহিনী পরিচালিত এই ডকইয়ার্ড হতে তৈরী রেসকিউ বোট সমূহ দ্বারা দূর্যোগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কর্মপ্রক্রিয়া, প্রতিষ্ঠানটির কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা মূলক ব্যাবস্থা, গ্রস প্রফিট এবং নীট প্রফিটসহ আনুষাঙ্গিক তথ্য উপস্থাপন করি। আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশের জনগন ও পাঠকগন অতঃপর সাবাসী ও মোবারকবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। একজন প্রাক্তন সশস্ত্রবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে এতে নিজে গর্ব অনুভব করেছি।

সেই লেখাটির ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পর্বে আজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে লিখতে বসেছি। নৌবাহিনীর সু-পরিচালনাকৃত প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রথম পর্ব শুরু করায় দুষ্টুমি করে আমার অনেক কাছের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীগন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন ” এই, তুমি কি নৌবাহিনীর অফিসার হয়ে গেলে নাকি? “

সেনাবাহিনী আমার গর্ব, ভালোবাসা ও আমার অহংকার। সার্বভৌমত্বের একজন সাবেক প্রহরী হিসাবে আজো আমি রিজার্ভ লিষ্টে ডাক পড়লে দেশের ডাকে সব মায়া ত্যাগ করে শত্রু মোকাবিলায় ১০০% প্রস্তুত আছি ও থাকবো আল্লাহ সুস্থ রাখলে। আজ তাই লিখতে বসেছি ট্রাষ্ট ব্যাংক লিমিটেড নিয়ে যার তথ্য সংগ্রহে ব্যাবহার করেছি তাদের ওয়েবসাইট www.tblbd.com

ট্রাষ্ট ব্যাংকটি নয় কোন সরকারি ব্যাংক। নয় এটি কোন রাষ্ট্রায়ত্ব লোকসানী প্রতিষ্ঠান। ইহা একটি বেসরকারী ব্যাংক যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট পরিচালিত বেসরকারী অন্যান্য সব প্রফেশনাল ব্যাংকের আদলে পরিচালিত।

আমাদের ট্রাষ্ট ব্যাংকটির নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাননীয় সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মুশফিক সহ আরো ক’জন পরিচালক যারা সেনাসদরের পরিচালক পদে কর্মরত। সর্বমোট দশজন পরিচালক ও দুজন স্বতন্ত্র পরিচালকের সমন্বয়ে ট্রাষ্ট ব্যাংক গঠিত।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন ১৯৯৯ সনে ট্রাষ্ট ব্যাংক পরিচালনা করার সরকারী অনুমোদন পায়, তখন সেনাবাহিনীর ছিলো না কোন ব্যাংক পরিচালনার পূর্ব অভিজ্ঞতা। হাঁটিহাঁটি পায়ে পায়ে যাত্রা শুরু করে আজ এই ট্রাষ্ট ব্যাংকটি মাশাআল্লাহ গত বছর প্রায় হাজার কোটি টাকা গ্রস প্রফিট অর্জন করে। করোনা পরবর্তী এই চ্যালেন্জকালে এই অর্জন একটি অসাধারণ সাফল্য বলে বিবেচিত। সঠিক নেতৃত্বের গুনে তথা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের আন্তরিক গাইডেন্সের কারণে কোভিড আক্রান্ত সকল সেক্টরের মাঝে এই অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। এরজন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদকে যথাযোগ্য কৃতিত্ব না দেওয়া হলে কৃপনের তকমা গায়ে লাগাবার সূযোগ আমি দিতে চাই না।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেয়। এর মাঝ নারী নেতৃত্বের প্রতি আস্হা ও সেনাবাহিনীর প্রথম নারী অফিসারকে মেজর জেনারেল হিসাবে নিয়োগ প্রসংশা কুড়িয়েছে বিশ্ব পরিমম্ডলে।

আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি সংক্ষেপে যাকে আমরা AFIP নামে জানি, তার কম্যান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল সুসানে গীতি আলহামদুলিল্লাহ সুনামের সাথে তার কর্মদক্ষতা প্রমাণ করে সেনাবাহিনীর সাহসী সিদ্ধান্তকে সফলতার আলো উপহার দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এরই ধারাবাহিকতায় আরেকটি বিপ্লবী পদক্ষেপ নেন। তা হলো আমাদের ট্রাষ্ট ব্যাংকের নেতৃত্ব আরেকজন সফল নারী ব্যাংকারের হাতে তুলে দেন।

বাংলাদেশের প্রথম মহিলা হিসাবে জনাবা হুমায়রা আজমকে ট্রাষ্ট ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও সিইও পদে নিয়োগ দেন ট্রাষ্ট ব্যাংকের সম্মানিত পরিচালনা পর্ষদ। নারী নেতৃত্ব প্রদানকারী এই ব্যাংকার নিজে এবং তার দলের সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শুনেছি একসাথে ব্যাংকে নয় শত জনের পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন এবং ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডারদের গত বছরে প্রায় ২২.৫% লভ্যাংশ নিশ্চিত করেন। একটি প্রফেশনাল ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নেতৃত্ব ও তার অধস্তনদের পরিচালনার সাফল্যের মাপকাঠি ব্যাংকের নীট লভ্যাংশ, এমপ্লয়িজ মোটিভেশন ও সু-কর্ম পরিবেশ দেখা যায়। ব্যাংকটিতে আজ গেলেই কর্মীদের মাঝে প্রাণের আওয়াজ পাওয়া যায়। বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি যে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মাননীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ এবং ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মুশফিক ব্যাংকটির উন্নয়নে নীরবে ভূমিকা রেখে চলছেন। আজকের অর্থাৎ গত বছরের এই লভ্যাংশ প্রদানে পরিচালনা পর্ষদের আন্তরিক অবদানকে অস্বীকার করার জো নেই কারণ Profitability of this Bank is recognised by Banking Sector Pundits.

নারী নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সেনাবাহিনীর ও মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই উদারতা প্রশংসা কুড়ায় সেনাবাহিনীর ঘোরতর সমালোচকদের মাঝেও।

এই ব্যাংকটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম ষ্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় ২০০৭ সনে। প্রতিটি শেয়ারের ফেস ভ্যালু ১০ টাকা এবং গত বৃহস্পতিবার তথা ১৯শে মে ২০২২ তারিখে প্রতিটি শেয়ারের বাজার মূল্য ছিল ৩৭.৫০ টাকা অর্থাৎ অভিহিত মূল্যের প্রায় ৪ গুন। ১,০০০ কোটি টাকা মূল্যের অথরাইজ ক্যাপিটাল, ৭০৭.৬২৬ কোটি টাকার পেইড আপ ক্যাপিটালসহ ১০৩১.৫৭ কোটি টাকার রিজার্ভ আছে এই ব্যাংকে। এই ব্যাংকের Price Earning (PE) Ratio ৭.৯২ যা বিনিয়োগ উপযোগী এবং Earning Per Share (EPS) ২.৮০ এবং Net Asset Value 2020 অনুযায়ী ২৭.৩৭ টাকা। এই ব্যাংক এই গতিতে চললে আগামী বছর ৩০% ডিভিডেন্ড দিলেও একজন বিনিয়োগকারী হিসাবে আমি আশ্চর্য হবো কি? তথ্যসূত্রঃ www.dsebd.org

গত ০৫ বছর ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের যে পরিমাণ লভ্যাংশ দিয়েছে, তা নিম্মে আপনাদের সকলের সদয় অবগতির জন্য দেয়া হলোঃ

২০২১ – ১২.৫০% নগদ + ১০% ষ্টক বোনাস, মোট ২২.৫০% ।

২০২০ – ১০% নগদ + ১০% ষ্টক বোনাস, মোট ২০%।

২০১৯ – ৫% নগদ + ১০% ষ্টক বোনাস, মোট ১৫%।

২০১৮ – ০% নগদ + ১০% স্টক, মোট ১০%।

২০১৭ – ২০% নগদ + ০% স্টক বোনাস, মোট ২০%।

এবার আপনারাই বলুন ব্যাংকটি কেমন ও সেনাবাহিনীর পরিচালনা কতোটুকু সাফল্য অর্জন করে মানুষের হৃদয়ে আস্থার মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছে।

এই ব্যাংকের ৬০% শেয়ার আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের। ২৩% জনগনের, ১৬% প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এবং ১% বিদেশী বিনিয়োগকারীর হাতে।

লেখাটি পড়ে পাঠক তার বিবেক বুদ্ধি ব্যাবহার করতঃ নিজেই সিদ্ধান্তে নিবেন বলে আশা করছি যে সরকার কর্তৃক ১৯৯৯ সনে ব্যাংকটির অনুমোদন এবং ২০০৭ সনে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করতঃ অন্যান্য সমসাময়িক ব্যাংকের তুলনায় কেমন অবস্থানে আছে?

আপনাদের মতামত ও গঠনমূলক সমালোচনা ব্যাংকটিকে একদিন দেশের এক নম্বর ব্যাংক হবার সুষ্ঠু প্রতিযোগিতায় নিশ্চিত উতসাহ জোগাবে বলে বিশ্বাস করি।

পরিশেষে আলোচ্য ট্রাষ্ট ব্যাংকটির উপরোক্ত তথ্যের পর্যালোচনায় আমি বাংলাদেশের একজন সামান্য নাগরিক এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সদস্য হিসাবে আমার,একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু মতামত পেশ করতঃ আপনাদের গঠনমূলক পরামর্শ চাহিয়া ইতি টানছি।

১। সঠিক নেতৃত্ব
২। ব্যাংককে ব্যাংকের মত অপারেট করতে পরিচালনা পর্ষদের সহায়ক ভূমিকা রাখা
৩। ব্যাংক পরিচালনা ম্যানেজমেন্টের উপর আস্হা, মনিটরিং ও বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলতে দেয়া
৪। ব্যাংকে নন প্রফেশনালদের অপসারণ করে পরিক্ষীত, সত ও ভালো ট্র্যাক রেকর্ড সম্বলিত জনবল নিয়োগ করা
৫। যোগ্য কর্মীদের পুরষ্কৃত করে একত্রিত টার্গেট অর্জন করা।।

ধন্যবাদান্তে,

মেজর (অবঃ) আহমেদ ফেরদৌস

সাবেক সেনা কর্মকর্তা,
মোঃপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।

ইমেইলঃ ahmedferdous987@gmail.com

Share this post

PinIt
scroll to top