রিকশা চালিয়ে সংসার চালান জান্নাত বেগম । দুধের শিশু ভাড়ায় রেখে যান অন্যের কাছে

জান্নাত বেগম। বয়স ২৮ বা ৩০। রাজধানীর মুগদা-মাণ্ডা এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। শুধু পেটের দায়ে নয়, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে প্রায় দেড় বছর বয়সী দুধের শিশুসন্তানকে পাশের আরেক নারীর কাছে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে পরিশ্রম করে চলেছেন দিনের পর দিন।

স্বামী আবুল কালাম থেকেও যেন নেই। একাধিক বিয়ে করে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। রিকশা চালিয়ে দিন শেষে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে সংসার। বছর দেড়েক আগে ছোট সন্তান জন্মদানের সময় ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন জান্নাত।

সেই ঋণ সুদে আসলে ৩০ হাজারে ঠেকেছে। মাণ্ডার এক বস্তিতে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি এই ঋণের টাকাও জোগাড় করতে হচ্ছে তাকে। সাথে শিশুসন্তান দেখাশোনার জন্য বস্তির আরেক নারীকে দৈনিক ১০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে জান্নাত বেগমকে।

গত বুধবার মাণ্ডায় গিয়ে কথা তার সাথে। একান্ত আলাপচারিতায় জান্নাত বেগম তার জীবনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন।
 

৩ বোন ও ১ ভাইয়ের সংসারে সবার বড় জান্নাত। বাবার সাথেই সংসারের হাল ধরতে ছোটবেলা থেকেই ঢাকার মাণ্ডা এলাকায় থাকেন তিনি। বছর আটেক আগে আবুল কালাম নামে একজনের সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় জান্নাত বেগমের। তখন তিনি গার্মেন্টকর্মী। আর স্বামী সেনিটারি মিস্ত্রি।

বিয়ের পর স্বামীর সংসার করতে থাকেন জান্নাত। আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন, স্বামী কালামের একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক রয়েছে। বিয়ে করেছেন একাধিক। এরই মধ্যে তার বড় সন্তান সাগরের জন্ম হয়। অভাবের সংসার। তাই জান্নাত কাজ নেন রাস্তা বা বিল্ডিং ঢালাইয়ের। স্বামীর সাথে সম্পর্ক দিন খারাপ হতে থাকে।

এরই মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে আসে জান্নাতের। তিনি যখন সন্তান সম্ভাবা তখন উধাও হয়ে যান স্বামী কালাম। সবকিছু মিলে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হন জান্নাত। সন্তান জন্মের সময় বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। আবার কয়েক মাস ঋণ করে খেয়েছেন। সবমলিয়ে প্রায় ২০ হাজার ধার নিয়েছিলেন। সেই টাকা সুদে আসলে ৩০ হাজারে ঠেকেছে।

জান্নাত বেগম জানান, ছোট ছেলের বয়স এখন এক বছর ৪ মাস। ভারী কাজ করতে পারি না। অনেকে তো ভিক্ষা করে খায়। আমি সে পথেও যাইনি। তাই সিদ্ধান্ত নেই রিকশা চালিয়ে সংসার চালাব। শুরুতে এলাকায় নানাজনে নানা কথা বলত। নানাজনে ডিস্টার্বও করত। এখন অনেকটাই সয়ে গেছি।

স্বামী পরিত্যক্তা এই নারী বলেন, ছোট বাচ্চা। তাকে ঘরে একা রেখে বের হওয়া যায় না। তাই পাশের ঘরের একজনের (নারী) কাছে দিনে ১০০ টাকা চুক্তিতে রেখে যাই। সেই সারাদিন দেখাশুনা করে। আমি সকালে রিকশা নিয়ে বের হই। কোনো দিন দুপুরে বাসায় ফিরি, কোনো দিন আবার ফেরা হয় না, সেই রাতে ফিরি। ছোট বাচ্চার জন্য মায়া লাগে। কিন্তু কী করব? পেটের দায়ে দুধের বাচ্চাকে রেখে রাস্তায় বের হতে হয়।

জান্নাতি বলেন, দিনে আড়াই শ’ টাকা হাজিরায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাড়ায় চালাই। দিনে ৭০০-৮০০ টাকার মতো আসে। কখনো আবার কমও হয়। মহাজনকে আড়াই শ’ টাকা পরিশাধ এবং সংসার খরচ চালিয়ে মাস শেষে যা থাকে, তা ঋণের টাকা দেয়ার চেষ্টা করছি। যদি নিজের অটোরিকশা থাকত তাহলে মাস শেষে আড়াই শ’ টাকা হারে প্রায় ৭ হাজার টাকা বেশি হাতে থাকত।
তিনি বলেন, এই যে করোনা গেল।

কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। সরকারের কাছে আবেদন, আমার তো কেউ নেই। যদি কমপক্ষে একটা ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবস্থা কেউ করে দিতো তাহলে কিছুটা হলেও আয় বাড়ত। আমার কষ্ট কমত। গত প্রায় ৬ মাস ধরে মুগদা ও মাণ্ডা এলাকার রাস্তায় সকাল থেকে রাত অবদি পুরুষের মতোই জীবিকার তাগিদে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন জান্নাত বেগম। তার বড় ছেলে ভোলায় নানীর কাছে বড় হচ্ছে।

মাণ্ডা এলাকার এক বস্তিতে শিশু সন্তানকে নিয়ে বাস করছেন। স্বামী নেই। তাই দুই সন্তানের তিনিই মা, তিনিই বাবা। তবুও ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় বের না হয়ে কাজ করে খাচ্ছেন এই সাহসী নারী।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top