ময়নামতি জাদুঘরে ভাংচুর: ৩১ প্রত্ন শ্রমিককে ফাঁসানোর অভিযোগ!

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল (সরেজমিন প্রতিবেদক):   নিজ কার্যালয়ের টেবিলের কাঁচ ভেঙে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছেন কুমিল্লা ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাসিবুল হাসান সুমি। এনিয়ে জাদুঘর ও শালবন বিহার এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন একটি খবর পেয়ে ময়নামতি জাদুঘর ও শালবন এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে খোঁজখবর নিলে বেরিয়ে আসে নানান রকম চাঞ্চ্যাল্যকর তথ্য।

গত ২৬ মে বুধবার। ঘরিতে তখন বেলা ১১টা ১০ মিনিট। আমরা হাজির হই কুমিল্লা ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান এর কার্যালয়ে। জাদুঘরের সামনের রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত কার্যালয়টি। সেদিন বৌদ্ধ পূর্ণিমার সরকারী ছুটি। তালা ঝুলছিলো কাস্টোডিয়ান এর কক্ষে। তবে, কার্যালয়ের অন্যান্য সব কক্ষ যথারীতি খোলা রয়েছে। পাশের একটি কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো কার্যালয়ের অধস্তন এক কর্মচারীর কক্ষে বসে আছেন কাস্টোডিয়ান হাসিবুল হাসান সুমি। আমাদের দেখতে পেয়ে ডেকে ভেতরে গিয়ে বসতে বললেন।

নিজের কক্ষ ছেড়ে অন্যের কক্ষে বসার কারন জানতে চাইলে তিনি অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনার কথা জানান। তিনি জানান, জাদুঘর ও শালবন বিহার এলাকায় দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকরা তার কক্ষে আক্রমণ করে ভাংচুর চালিয়েছে। এটি গত ২২ মে শনিবার সকালের ঘটনা।

হাসিবুল হাসান সুমি বলেন, ‘ওরা দলগতভাবে এসে আমার ওপর চড়াও হয় এবং এখানে ভাঙচুর চালায়। এসময় ওদের হাতে দেশীয় ধারালো অস্ত্র ছিলো।’

তার নিয়ন্ত্রানাধীন শ্রমিকরা হঠাৎ করেই কেন তার উপর চড়াও হলো জানতে চাইলে কাস্টোডিয়ান হাসিবুল হাসান সুমি বলেন, ‘ওদের কিছু দাবিদাওয়ার বিষয় ছিলো। সেই সাথে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শালবন বিহারের এক বুকিং সহকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ওরা (শ্রমিকরা) আঞ্চলিক পরিচালকের কাছে দরখাস্ত দিয়েছিলো।

নিয়ম অনুযায়ী ওরা দরখাস্তটি আমার কাছে দিতে পারতো, তা না করে সরাসরি আঞ্চলিক পরিচালকের কাছে দিয়েছে। এক্ষেত্রে ওরা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়েছে। ওদের করা ওই দরখাস্তেরই তদন্ত চলছিলো। এবিষয়ে প্রভাবিত করতেই এমনটি করেছে। তাই, নিরাপত্তার স্বার্থে ২৪ মে আমি বিষয়টি লিখিত ভাবে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানাকে জানাই।’

সাংবাদিকদের অনুরোধে কাস্টোডিয়ান তার নিজের কক্ষটি খোলে দিলে দেখা যায়, মেঝেতে কয়েকটি বই পড়ে আছে। টেবিলের কাচ ভাঙা সেই সাথে আলমারির কাচও ভাঙা!

এই ভাংচুরের ঘটনার সাথে কতোজন জড়িত ছিলো জানতে চাইলে কাস্টোডিয়ান বলেন, ‘আমিতো গোনে দেখিনি। তবে, আমি মনেকরি দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে নিয়োজিত ৩১জন শ্রমিকই এর সাথে জড়িত।’

ঘটনার পাঁচদিন অতিবাহিত হয়েছে (২৬ মে)। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে (আঞ্চলিক পরিচালককে) জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওনাকে (আঞ্চলিক পরিচালককে) জানাইনি। তবে, ২৪ মে আমাদের অধিদপ্তরের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে জানিয়েছি।’

এটি একটি সরকারী অফিস সেই সাথে আপনারও নিরাপত্তার বিষয় জড়িত তাহলে তাৎক্ষনিক ভাবে কোনো আইনী পদক্ষেপ না নিয়ে ঘটনার দুই দিন পর কেন জানালেন? তাছাড়া উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নিয়ম থাকলেও থানায় অভিযোগ করার আগে উর্ধ্বতন কাউকে না জানানোর কারন কী? এমন প্রশ্নের জবাবে কাস্টোডিয়ান বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় লিখিত ভাবে অভিযোগ করতে দেরী হয়েছে। আর ‘তিনি (আঞ্চলিক পরিচালক) আমার কথা শুনতে চান না। তাই ওনাকে জানাইনি।’

এসময় তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অভিযুক্ত বুকিং সহকারী নজরুলকে প্রশ্ন করতে চাইলে কাস্টোডিয়ান বারণ করেন এবং এটি তদন্তাধীন বিষয় উল্লেখ করে নিজেও সব প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান। এদিকে কাস্টোডিয়ানের বর্ননা অনুযায়ী ঘটনার তারিখ এবং অভিযোগের তারিখ শোনে কিছুটা খটকা লাগে আমাদের।

কিছুক্ষণ পরেই একজন কর্মচারী এসে কাস্টোডিয়ানের কার্যালয়ের সামনে আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান আসার খবর জানান। এসময় উপস্থিত সকল কর্মচারী আঞ্চলিক পরিচালক এর গাড়ীর কাছে ছুটে গেলেও কক্ষেই বসে ছিলেন কাস্টোডিয়ান। আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান কিছুক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে থেকে জাদুঘরের পেছনে গেস্ট হাউসের দিকে চলে যান।

পরে সেখানে গিয়ে আঞ্চলিক পরিচালকের কাছে কস্টোডিয়ানের কক্ষে ভাংচুরের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন সময় ব্লাঙ্ক পেপারে (সাদা কাগজে) শ্রমিকদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিচ্ছেন কাস্টোডিয়ান কার্যালয়ের বুকিং সহকারী নজরুল। এ মর্মে ২৭জন শ্রমিক গত ১৭মে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ করে। এটা নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত চলমান রয়েছে। এসময় যদি শ্রমিকরা এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতো তাহলে এতদিনেও সে আমার কাছে লিখিত বা মৌখিক কোনো অভিযোগ দাখিল করেনি কেন?

১৭ মে শ্রমিকদের করা অভিযোগের দায় এড়াতে কিংবা দরখাস্তটি তার কাছে না দেয়াতেই কাস্টোডিয়ান নিজেই পরিকল্পিত ভাবে এমনটি ঘটিয়েছে কিনা; বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ বাড়িয়ে তুলছে। তাছাড়া ঘটনার পরপরই কয়েকজন শ্রমিক আমার কার্যালয়ে এসে বিষয়টি খুলে বলেছে। তারা জানায়, কাস্টোডিয়ান তার কার্যালয়ে শ্রমিকদের ডেকে এনে নিজেই উত্তেজিত হয়ে টেবিলে থাপ্পর মেরে এর কাচটি ভেঙে ফেলে, উল্টো তাদেরই চাকুরী খাবার হুমকী দেন।’

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা শ্রমিক আলকাছ মিয়াসহ নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শ্রমিক জানান, ২২ মে বিকেলে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর এলাকার দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক শ্রমিকরা তাদের দা-ছেনি ধার করানোর টাকাসহ কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে কাস্টোডিয়ান হাসিবুল হাসান সুমির কাছে যান। এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে কাস্টোডিয়ান নিজেই টেবিলে সজোরে থাপ্পর মারেন। সাথে সাথে টেবিলের কাচ ভেঙে যায়। এরপর তিনি শ্রমিকদের বলেন, ‘তোমরা এ কাচ ভেঙেছ। কারো প্ররোচনায় তোমরা এ কাজ করেছ। তোমাদের সবার চাকরি থাকবে না।’

শালবনের পার্শ্ববর্তী সালমানপুর এলাকার শ্রমিক আলকাছ মিয়া বলেন, ‘কিছু দাবি নিয়ে আমরা কাস্টোডিয়ানের রুমে যাই। উনি (কাস্টোডিয়ান) মেজাজি লোক। একপর্যায়ে কাস্টোডিয়ান উত্তেজিত হয়ে পড়েন। উত্তেজিত অবস্থায় তিনি সজোরে টেবিলে থাপ্পড় মারলে টেবিলটি ভেঙে যায়। এরপর তিনি আমাদের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেন, কারও চাকরি থাকবে না। এতে আমরা ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে যাই। এরপর ভুলেও সেখানে যাইনি। কিন্তু, তিনিই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন!’

শালবন বিহার এলাকা থেকে ফেরার পথে আমরা আবারও কাস্টোডিয়ানের কার্যালয়ে গিয়ে তার সাথে দেখা করি। কাস্টোডিয়ান নিজেই তার টেবিলের কাচ ভেঙেছেন শ্রমিকদের করা এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর কোনো সদোত্তর দিতে পাারেননি। এবার তিনি বোল পাল্টে নিজেই কাচ ভাঙার কথা স্বীকার করে বলেন, এটি ২২ তারিখের নয়, এটি ২১ তারিখের ঘটনা। আমার কক্ষে অনেক কিছুই হতে পারি, রাগান্বিত হতে পারি।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফজল খান জানান, চাকরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা ওইদিনই তার কাছে গিয়ে বিষয়টি খুলে বলেন। পরদিন কাউন্সিলর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে নিয়ে কাস্টোডিয়ানের সাথে দেখা করেন এবং শ্রমিকদের যাতে কোনোপ্রকার সমস্যা না হয়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখার অনুরোধ করেন।

কাউন্সিলর ফজল খান বলেন, ‘শ্রমিকরা আমার এলাকার। ওদের আমি ভালো করেই চিনি। ছোটবেলা থেকে ওরা এখানে কাজ করছে। ওরা এখানকার কোনো কর্মকর্তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতেও ভয় পায়। কাউন্সিলর দৃঢ়তার সাথে বলেন, ওরা ভাঙচুর করতে পারে, এটা আমার বিশ্বাস করি না।’

এব্যাপারে ২৭ মে বৃহষ্পতিবার বিকেলে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার অফিসার ইনচার্জ দেবাশীষ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘মূলতঃ এ বিষয়ে আমি কাস্টোডিয়ানের কাছ থেকে কোনে প্রকার অভিযোগ পাইনি। বরং সরকারী অফিসে ভাংচুরের ঘটনা জেনে ২৫ মে আমি নিজ থেকেই একজন অফিসার পাঠাই। তিনি কাস্টোডিয়ানকে এ বিষয়ে অভিযোগ দিতে বলে আসলেও আজ পর্যন্ত তিনি লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ করেননি।

তাই গতকাল (বুধবার) বিকেলেও একজন অফিসার পাঠাই। এরপর গতকাল সন্ধ্যায় তিনি (কাস্টোডিয়ান) আমাকে ফোন করে বলেছেন, আজ দেখা করে কথা বলতে চান। কিন্তু এখনও আসেননি। তবে, আমার অফিসারের প্রাথমিক তদন্তেÍ তেমন কিছু পাইনি। মূলত, তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top