তুমুল বিরোধে উত্তপ্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দুই রাজ্য আসাম ও মিজোরাম। গত সোমবার স্থানীয়দের সংঘর্ষের পাশাপাশি গুলি বিনিময় হয়েছে রাজ্য দুটির পুলিশ বাহিনীর মধ্যে। এতে আসামের পাঁচ পুলিশ নিহত হয়েছেন। সহিংসতার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে উভয় রাজ্য। বিরোধ মেটাতে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
কীসের এই বিরোধ?
বাংলাদেশের পূর্ব দিকে অবস্থিত ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম আসাম ও মিজোরাম। আসামের তিন জেলা- চাঁচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জের সঙ্গে মিজোরামের আইজল, কোলাসিব ও মামিত জেলার ১৬৪ কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্তের বেশ কিছু জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুই রাজ্যের বিরোধ চলে আসছে।
উভয় রাজ্যের বাসিন্দারা এসব জমির মালিকানা দাবি করেন। এমনকি, সেখানে অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখা হয়। এ নিয়ে প্রায়ই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। তবে এবারই প্রথম সহিংসতার সময় এক রাজ্যের পুলিশ অন্য রাজ্যের পুলিশের দিকে গুলি ছুড়ল।
কেন্দ্রীয় সরকার দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দুই রাজ্যের বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করে আসছে। সোমবার দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। এসময় তাদের কাছে সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সমস্যা কোথায়?
ঔপনিবেশিক শাসনামলে মিজোরাম তথা লুসাই পাহাড় আসামের অংশ ছিল। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় তিন দশক পর ১৯৭২ সালে আলাদা হয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয় মিজোরাম। ১৯৮৭ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা পায়।
দুই রাজ্যের মধ্যে প্রথম বিরোধ দেখা দেয় ১৯৯৪ সালে। এর জেরে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যস্থতায় কয়েক দফা আলোচনায় বসে উভয় পক্ষ। তবে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে।
২০২০ সালের অক্টোবরে উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সেসময় দুই রাজ্যের বাসিন্দারা মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুইবার সংঘর্ষে জড়ান। এতে আহত হন অন্তত আটজন। উভয় পাশে ছোট দোকান ও ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।
সেই উত্তেজনার মূলে ছিল আসাম সরকার পরিচালিত একটি উচ্ছেদ অভিযান। অভিযোগ রয়েছে, সীমান্তের বিরোধপূর্ণ এলাকার একটি ফার্মহাউস ও ফসল পুড়িয়ে দিয়েছিল আসাম কর্তৃপক্ষ। জবাবে বিরোধপূর্ণ যেসব এলাকা আসাম নিজের বলে দাবি করে, সেখানে সেনা মোতায়েন করে মিজোরাম সরকার।
সেসময় উভয় পাশের বাসিন্দারা প্রধান মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছিলেন, যার ফলে প্রায় তিন সপ্তাহ যান চলাচল বন্ধ ছিল। পরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
কী হয়েছে সোমবার?
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, বিতর্কিত সীমান্ত পয়েন্ট লাইলাপুরের দু’পাশে পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে উত্তেজনা বেড়ে যায়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী টুইটারে অভিযোগ করেছেন, তার রাজ্যের পুলিশ কর্মকর্তারা ‘সাংবিধানিক সীমান্ত’ রক্ষা করার সময় মিজোরাম বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
আসাম পুলিশও অভিযোগ করেছে, মিজোরামের ‘দুর্বৃত্তরা’ তাদের দিকে পাথর ছুড়েছে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করেছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিজোরাম সরকার। রাজ্যটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালচামলিয়ানা বলেছেন, আসাম পুলিশের সদস্যরা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) একটি নিরাপত্তাচৌকি ‘জোরপূর্বক’ পার হয়ে আসার পরেই ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে গুলি চালিয়ে’ জবাব দেয় মিজোরাম পুলিশ।
আসাম-মিজোরামের বিরোধপূর্ণ সীমান্তে ‘নিরপেক্ষ বাহিনী’ হিসেবে সিআরপিএফ মোতায়েন রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
সর্বশেষ
সোমবারের সংঘর্ষে পাঁচ পুলিশসহ ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনদিনের শোক ঘোষণা করেছে আসাম সরকার। রাজ্যটির ক্ষুব্ধ জনতা চাঁচার জেলায় আসাম-মিজোরাম মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে। সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসাম সরকার।
আসাম-মিজোরাম সহিংসতার ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তার অভিযোগ, অমিত শাহ জনগণের মধ্যে ‘বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের বীজ বপন করে’ দেশকে ‘ব্যর্থ’ করে দিয়েছেন এবং ভারত এখন তার ‘ভয়াবহ পরিণতি’ ভোগ করছে।
তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায় বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার বরবরই মনে করে, আন্তঃরাজ্য বিরোধ কেবল সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমেই সমাধান করা যায় এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার শুধু সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
সূত্র: বিবিসি, নিউজ ১৮