বাংলাদেশে ভুয়া করোনা সনদ বিক্রির বিশাল ব্যবসা: নিউইয়র্ক টাইমস

কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে ভুয়া করোনা নেগেটিভ সনদ বিক্রির খবর ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল ইতালির গণমাধ্যমে। একই কারণে এবার প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসেও নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হলো বাংলাদেশ। সম্প্রতি দেশে সাহেদের গ্রেফতারকাণ্ড এবং তার মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালে ভুয়া করোনা নেগেটিভ সনদ বিক্রি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিশদ প্রতিবেদন করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।

এতে বলা হয়েছে, গত বুধবার বোরকা পরে নারী সেজে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্ত থেকে গ্রেফতার হয়েছেন ‘পুরোনো অপরাধী’ মোহাম্মদ সাহেদ। তার রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকার (৫৯ মার্কিন ডলার) বিনিময়ে পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া করোনা নেগেটিভ সনদ দেয়া হতো।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, বাংলাদেশে বিদেশগামী শ্রমিকদের মধ্যে এ ধরনের ভুয়া করোনা নেগেটিভ সনদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ধরনের প্রবাসীরা সাধারণত ইউরোপের বিভিন্ন মুদি দোকান, রেস্টুরেন্ট কিংবা রাস্তায় পানি বিক্রি করেন বলে উল্লেখ করেছে পত্রিকাটি।

সাহেদের বিষয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ভুয়া করোনা সনদ বিক্রির ঘটনা সামনে আসার অনেক আগে থেকেই তিনি বিভিন্ন দুর্নীতি ও অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩০টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাহেদ দুই বছর জেলও খেটেছেন।

সম্প্রতি করোনা সনদ দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরুর পরপরই গা ঢাকা দেন রিজেন্ট হাসপাতালের এ কর্ণধার। টানা নয়দিন অনুসন্ধানের পর বুধবার তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া, ভুয়া করোনা সনদ বিক্রির দায়ে ঢাকায় গ্রেফতার হয়েছেন অন্য দুই চিকিৎসকও। এ ধরনের অপরাধীদের ধরতে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এ নিয়ে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভুয়া করোনা সনদ ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ওপর বড় আঘাত। তিনি জানিয়েছেন, দেশে বেশ কয়েকটি অপরাধী চক্র বিদেশগামী শ্রমিকদের করোনা নেগেটিভ সনদ সরবরাহ করছে এবং এর মাধ্যমে বহু মানুষের জীবন বিপন্ন করছে।

বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শুধু রিজেন্ট হাসপাতাল থেকেই ১০ হাজারের বেশি করোনা সনদ ছাড়া হয়েছে, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করা হয়নি।

বাংলাদেশের বিষয়ে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশ। লাখ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করে শত শত কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, যা দেশের অর্থনীতির গতি ধরে রেখেছে। তবে করোনাভাইরাস মহামারির সময় অনেক প্রবাসী অল্পসময়ের জন্য দেশে ফিরে আটকে গেছেন। ফলে চাকরি হারানোর ভয়ে তারা কর্মস্থলে ফিরে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

একই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতিকে অস্পষ্ট বলে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় এ সংবাদমাধ্যমটি। তারা বলছে, প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে দুই লাখের মতো মানুষ করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় যে গতিতে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে এবং বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষার হার তুলনামূলক কম হওয়ায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, দেশটিতে করোনায় প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।

শুধু বাংলাদেশে করোনা সনদ জালিয়াতিই নয়, এ নিয়ে ইতালিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও বড় করে প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটি বলছে, রোমে পৌঁছে ৩৭ বাংলাদেশি করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের সব ফ্লাইট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্তো স্পেরাঞ্জা। গত সপ্তাহে রোম ও মিলান বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ১৬৮ বাংলাদেশিকে।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সম্প্রতি দেশটি থেকে যে ১ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি ইতালি গেছেন, তাদের কেউই ভুয়া করোনা সনদ ব্যবহার করেননি। তবে, ইতালি যাওয়া কিছু বাংলাদেশি বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন নীতি মানেননি, ফলে তাদের কয়েকজন ভাইরাস বহন করতে পারেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইতালির লাজিও অঞ্চলের মুখপাত্র জিউসেপ মাজ্জারা জানিয়েছেন, গত জুনে ইতালি যাওয়া বাংলাদেশি ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিসহ অন্তত ছয় হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৯১ জনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে।

মিলানের একটি রেস্টুরেন্টে কর্মরত তাহির হুসাইন নামে এক বাংলাদেশি ইতালীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ইতালির সংবাদপত্রগুলো বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে করোনা ছড়ানোর বিষয়ে লাগাতার সংবাদ প্রকাশ করছে। এতে সাধারণ শ্রমিকদেরও সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।

তার কথায়, ‘মানুষজন এখন আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়, যেন আমরা সবাই ভাইরাসে আক্রান্ত।’

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top