সারা দেশে অনলাইন প্রতারক চক্রের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। ফেইসবুক সহ সবধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার একাউন্ট হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এইসব সাইবার প্রতারকচক্র এর সদস্যরা।
সারাদেশে এমন অনেকগুলো সাইবার প্রতারকচক্র সক্রিয় আছে। এই সাইবার প্রতারকচক্ররা ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকের মাধ্যমে প্রবাসী, দেশের বিত্তশালী ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বড় অংকের টাকা আদায় করে।
সিলেট থেকে নাফিসা ( ছদ্ম নাম বা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ) এক মেয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে জানায় তার এক চাচার ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে তাকে ম্যাসেজ পাঠানো হয় টাকা বিকাশ করার জন্য। সেই মেয়ে ঐ আইডি ফিরত চাওয়াতে প্রিন্স সৌদ নামের একটি আইডি থেকে তার কাছে ৫০০ টাকা বিকাশ করতে বলা হয়। মেয়েটি আইডি ফিরে পাওয়ার আশায় ৫০০ টাকা বিকাশ করে ০১৯১২২১৯৯৬৮ এই নাম্বারে। এবং ০১৯৭৮৪৫৬৭৪৫ নাম্বারে ১৫৫০ টাকা চাওয়া হয় একাউন্টের তথ্য পরিবর্তন করে দিবে বলে।কিন্তু টাকা বিকাশ করার পর থেকে এই নাম্বার বন্ধ এবং ফেইসবুকে যোগাযোগ করলে বলে আজ নয় কাল দিচ্ছি। এইভাবেই সিলেট সহ সারাদেশে প্রতারণা করে যাচ্ছে এইসব সাইবার প্রতারকচক্রের সদস্যরা।
কিছুদিন আগে ৮ আক্টোবর (বৃহস্পতিবার) সিলেটে অনলাইন প্রতারক চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৯। গত ৮ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার ) তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, প্রতারণা চক্রের প্রধান মামুন মিয়া (২০) ও তার অন্যতম সহযোগী আফজাল হোসেন (২০)। তবে এই চক্রের আরেক সদস্য জাবের আহম্মেদকে (২৯) গ্রেপ্তার করতে পারেনি র্যাব। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গত ৮ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার ) সিলেট শহরতলীর মুরাদপুরস্থ র্যাব-৯ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের এসব তথ্য জানান র্যাব-৯ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু মুসা মো. শরীফুল ইসলাম।
এর আগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ( শনিবার) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীসহ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে জনপ্রতি মাসে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করত ‘টিম সিলেট নামের চক্রটি’। তারা গত তিন বছরে বিশ হাজার আইডি হ্যাক করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এদের টিম লিডার আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে থাকা ২০ সদস্যের টিমটি পরিচালনা করতেন। শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-২ এর অধিনায়ক ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ কথা বলেন।
আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, এ গ্রুপের মূল হোতা নাসির যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক সাইবার অপরাধী, যিনি কিছুদিন আগে সাইবার অপরাধের দায়ে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হয়েছিলেন। নাসিরই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হ্যাকার গ্রুপে লোক নিয়োগ করেন। এরপর অনলাইনে ভিডিও টিউটরিয়ালের মাধ্যমে ফেসবুক আইডি হ্যাক করার প্রক্রিয়া শেখান। আইডি ফেরত দিতে সতর্কতার সঙ্গে অর্থ লেনদেনসহ সব প্রক্রিয়াটি নাসির সমন্বয় করেন। দেশে তিনি মীর মাসুদ রানা, সৌরভ, বাবলু রহমান, আতিক, জেইনা রাইহান, আফরাজ মিম আশা, সারাকা মজুমদার, সিনথিয়া, তানভি, সুমাইয়া, রুবিসহ একটি সাইবার অপরাধী চক্র গড়ে তুলেছেন।
ফেসবুক আইডি হ্যাক করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে র্যাব জানায়, যে ফেসবুক আইডিটি হ্যাকাররা দখলে নিতে চায়, সেটির বিরুদ্ধে হ্যাকাররা বারবার ফেসবুকে মিথ্যা কারণ দেখিয়ে রিপোর্ট করে আইডি নিষ্ক্রিয় করে দেয়। পরে দুর্বল পাসওয়ার্ড কিংবা ‘টু স্টেপ ভেরিফিকেশন’ না থাকায় নিজেদের তৈরি ফেইক ই-মেইল দিয়ে ফেসবুকের কাছে অ্যাকাউন্টের মালিক দাবি করে আইডি দখলে নেয়।
দ্বিতীয়ত, হ্যাকাররা টার্গেটেড আইডির জন্য প্র্রয়োজনীয় ফেইক জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে ফেসবুকে দেয়। এরপর ফেসবুক তাদের ফেইক ই-মেইলে অ্যাকাউন্ট রিকভারি লিঙ্ক দেয়। লিঙ্কটি ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট পাসওয়ার্ড রিসেট করে অ্যাকাউন্টের পূর্ববর্তী তথ্য যেমন- ই-মেইল, ফোন নম্বর পরিবর্তন করে দেয়। একইসঙ্গে অ্যাকাউন্টে তিনটি বিশ্বস্ত অ্যাকাউন্ট অ্যাড করে দেয়, যা হ্যাকারদের নিজেদেরই ফেইক অ্যাকাউন্ট। ফলে মূল আইডির মালিকের পক্ষে অ্যাকাউন্ট রিকভারি বা ফেরত পাওয়া সম্ভব হয় না।
তৃতীয়ত, হ্যাকার গ্রুপ টার্গেটেড ফেসবুক আইডির মালিক বা তার পরিচিত কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে আইডি ফেরত পেতে টাকা দাবি করে। অন্যথায় আইডির ওয়ালে বিভিন্ন কুরূচিপূর্ণ ছবি পোস্ট করে বা মেসেঞ্জারে তার নিকটস্থ বন্ধুদের কাছে স্পর্শকাতর ছবি বা মেসেজ পাঠিয়ে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করতে থাকে।
এদিকে ঢাকা র্যাব-২ এর অধিনায়ক ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সবাইকে সাবধানে ফেসবুকসহ অন্যান্য অনলাইনের মাধ্যমগুলো সাবধানে ব্যবহার করতে বলেন। সেই সাথে নিজের বন্ধু তালিকায় পরিচিতজনদের বাহিরে না রাখার আহ্বান জানান তিনি।