সাংবাদিক নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন

আপনারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে যাবেন, আর সাংবাদিকরা লিখবে না। তা কি করে হয় ? আর সাহসী সাংবাদিক লিখলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে আটক রেখে হেনস্থা করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আবার মামলা করবেন । মনে রাখবেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যারা অপব্যবহার করে এবং অন্যের উপর জুলুম নির্যাতন করে, তারা টিকতে পারে না।

বাংলাদেশে একের পর এক সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক উল্টো মামলা দিয়ে সাংবাদিকদেরই হয়রানি করা হয়৷ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন প্রশাসনের উদাসীনতাই এই ধরনের ঘটনা উস্কে দিচ্ছে৷

দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বসে বিভিন্ন ভাবে নিরীহ জনগণকে হয়রানি, জুলুল নির্যাতন করছে। এতে করে সরকারের এতো উন্নয়ন এবং অর্জন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। 

দেশের নিরীহ জনগণকে কোনো ধরনের হয়রানি না করতে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্ঠায় কুচক্রী মহল ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। 

দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন জাতির বিবেক বলে পরিচিত সাংবাদিক সমাজ। বস্তুনিষ্ঠ সত্য সংবাদ প্রকাশ হলেই তাদের ওপর নেমে আসে লৌমহর্ষক নির্যাতন। যেটা কোন সভ্য দেশের মানুষ আশা করে না।

জাতীয় দৈনিক ও আসকের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, গত বছর করোনার মধ্যে বাংলাদেশে ৩ জন সাংবাদিক অপহৃত ও এক জন নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোট ২৫৬ জন সাংবাদিক প্রভাবশালী পক্ষের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।  গত চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল ২০২১) ৯১ জন সাংবাদিক  নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। অপরদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬৫টি মামলায় ১২২ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং ৪৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

কেবল এপ্রিল মাসেই ৪৬টি মামলায় ৭৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক সাংবাদিক রয়েছেন। প্রায়ই দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী কিংবা সমর্থকরা এ আইনে মামলা করছেন। আবার যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে, তাদেরকে দ্রুততার সঙ্গে গ্রেফতারও করা হচ্ছে। অধিকাংশ সময় তাদের জামিন হচ্ছে না। ফলে তাদের জেল খাটতে হচ্ছে।

গত কয়েকবছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে মনে রাখার মতো যেকটি রিপোর্ট হয়েছে, তার বেশিরভাগই রোজিনা ইসলামের করা। বাংলাদেশের একজন রিপোর্টারের পক্ষে যেকটি পুরস্কার জেতা সম্ভব, রোজিনা তার সবগুলো জিতেছেন, বারবার জিতেছেন। এ সবই তার অর্জন, কঠিন পরিশ্রমের ফল। 

রোজিনা ইসলাম সাহসী সাংবাদিক। মন্ত্রী, এমপি, আমলা, মাস্তান, প্রভাবশালী- কাউকেই ছাড়তেন না। তার একেক রিপোর্টে কত জনের আরাম হারাম হয়ে গেছে, কত জনের জমানো স্বর্ণ তামা হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে সেখানে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ তাঁকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। রাত পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ জানায়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। তাঁকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। 

রোজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সরকারি নথি চুরি করেছেন বা ছবি তুলেছেন। আসলেই চুরি করেছেন কিনা জানি না। যদি করেও থাকেন, প্রিয় আমলারা, রোজিনা ব্যক্তিস্বার্থে করেননি, সাংবাদিকতার জন্য করেছেন। আর সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। সচিবালয়ের নথি চুরি নয়, রোজিনার আসল অপরাধ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির পুকুর চুরির খবর ফাঁস করে দেয়া।

মহা দাপুটে আমলা স্যারেরা নথি চোর ধরার পর তো আপনাদের দায়িত্ব ছিলো পুলিশ ডেকে তাকে সোপর্দ করা এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে মামলা করা। সেটা না করে আপনারা কেন তাকে ছয় ঘণ্টা তাকে আটকে রাখলেন, কেন তাকে মারধোর করলেন, অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা কোন আইনে তার গলা টিপে ধরলেন? ধরে নিচ্ছি রোজিনা কেউ না, সাংবাদিক না, রিপোর্টার না; বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক, একজন নারী। তাহলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলারা কোন আইনে একজন নারীকে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখলেন?

দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়কে যারা ছয় ঘণ্টার জন্য সিনেমার টর্চার সেল বানিয়ে ফেললেন, যিনি রোজিনাকে গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছেন, মুক্ত সাংবাদিকতার গলা টিপে ধরেছেন। তাদের প্রত্যেকের বিচার চাই। সচিবালয় কারো মাস্তানি করার জায়গা নয়। রোজিনা নথি চুরি করেছেন কি করেন নি, সেটা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতে প্রমাণ হবে। আইন নিজের গতিতেই চলবে। 

একজন সংবাদকর্মী হিসাবে সরকারের কাছে আকুল আবেদন সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আলাদা আইন প্রণয়ন করুন এবং একজন নারীকে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে যারা মারাত্মকভাবে আইন ভঙ্গ করলেন তাদের আইনের আওতায় আনা না হলে ভবিষ্যতে শৃঙ্খলা থাকবে না। সবাই সচিবালয়কে মাস্তানদের আখড়া ভাববে।

আমি চাই, গণমাধ্যম মুক্তি পাক।  তাই ঐ ঘটনার সঠিক বিচার চাই এবং যারা সাহসী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্থা ও যিনি গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছেন, তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই!  আমরা সবাই সাহসী সাংবাদিকতার পাশে আছি, আমরা রোজিনার পাশে আছি। সাহসী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই!

লেখকঃ আহমেদ আজম , সম্পাদক ও প্রকাশকঃ প্রথম খবর

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top