বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন দুঃসংবাদ শুনিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কোরবানির আগে বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলে পাউবো আশঙ্কা করছে।
পাউবো জানায়, আজ মঙ্গলবার থেকে চার দিন ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ফের ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে বন্যার আরো অবনতির শঙ্কা রয়েছে।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, উজানে আগামী কয়েক দিনের বৃষ্টি ও ঢলের কারণে দেশের নদ-নদীতে পানির চাপ বাড়তে পারে। তবে পানি বাড়লেও আগামী রবিবার থেকে পদ্মার পানি কমতে পারে। জুলাইয়ের শেষ কিংবা আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের ভবানীপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল আজিজ। বন্যায় তলিয়ে যায় তাঁর গোয়ালঘর। ঘরও পানিতে থইথই। নিজেরই থাকার উপায় নেই, এর ওপর গবাদি পশু নিয়ে পড়েন আরো বেকায়দায়। তাই বাধ্য হয়ে আগেভাগেই কোরবানির হাটে পশু বিক্রি করতে এসেছেন।
গতকাল রবিবার জগন্নাথপুর পৌর শহরের হেলিপ্যাড এলাকায় কোরবানির পশুর হাটে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, করোনা আর বন্যা পরিস্থিতিতে কৃষকরা ভালো নেই। তাই কোরবানির ঈদ সামনে রেখে তাঁরা হাটে গবাদি পশু বিক্রি করে দিচ্ছেন। শুধু আব্দুল আজিজই নন, ওই পশুর হাটের বেশির ভাগ বিক্রেতাই দরিদ্র কৃষক। দু-একজনকে পাওয়া গেছে খামারি। নানা সংকটে পড়ে কোরবানির হাটে ঘরের গরু বিক্রি করে দিচ্ছে অভাবীরা।
একই পরিস্থিতি দেখা গেছে কুড়িগ্রামেও। বন্যায় গরু-ছাগল নিয়ে সংকটে রয়েছে অনেকেই। রাস্তা ও উঁচু স্থানে কোনোমতে গবাদি পশু রেখে বিক্রির চেষ্টা করছেন তাঁরা; কিন্তু চাহিদা ও দাম কম থাকায় গবাদি পশু বিক্রি তেমন একটা হচ্ছে না। কুড়িগ্রামের খামারিরা জানান, চরের মানুষের প্রধান সম্পদ গবাদি পশু। কোরবানির সময় অনেকেই গরু-ছাগল বিক্রি করে সংসারের চাকা সচল রাখেন। কেউ বা শোধ করেন ঋণ। কিন্তু এবারের ছবিটা একেবারেই ভিন্ন। করোনা ও বন্যার প্রভাবে নেমে গেছে কোরবানি পশুর দাম। কুড়িগ্রামের হলোখানা গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, বাড়িতে বন্যার পানি ওঠার পর বাঁধের ওপর গরু রেখেছেন। ঘাস খাওয়াতে পারছেন না। কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু পালন করেছেন; কিন্তু বিক্রি করতে পারছেন না। ৫০ হাজার টাকার গরু এবার ৩০ হাজার টাকা হয়ে গেছে।
এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দারা এখনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে ভোগান্তির মধ্যে দিন পার করছে।
গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তার পানি ফের বাড়তে শুরু করেছে। ফলে তৃতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে জেলার ২৬টি ইউনিয়নের বিভিন্ন চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি।
কুড়িগ্রামে নতুন করে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। গতকাল রবিবার ভোর ৬টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে নুনখাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১২ সেন্টিমিটার, সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৯ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি ১০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। বিকেলে ধরলার পানি বিপত্সীমার ৫৫ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের নুনখাওয়ায় ৫১ সেন্টিমিটার ও চিলমারীতে ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জে দুই দিন ধরে যমুনার পানি কমতে থাকলেও কমেনি বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। এখনো অনেক বসতবাড়ি ডুবে রয়েছে। এখনো পানিবন্দি রয়েছে জেলার সোয়া দুই লাখ মানুষ।
এদিকে পঞ্চগড়ের তালমা নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চগড় সদর ইউনিয়নের ফকিরপাড়া এলাকায়। ভাঙনে ওই এলাকার পুরনো রাস্তাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নওগাঁর আত্রাই নদের বেশ কয়েক স্থানে বাঁধ ভেঙে ও যমুনা নদীর শহর রক্ষা বাঁধের আউটলেট দিয়ে পানি ঢুকে কমপক্ষে চার হাজার ১৯৪ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল ও বীজতলা তলিয়ে গেছে। রংপুরের পীরগাছার বিস্তীর্ণ এলাকা ফের প্লাবিত হচ্ছে। ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে অনেক পুকুর ও খামারের মাছ।
এদিকে মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পদ্মার পানি বেড়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টায় পাউবো জানিয়েছে, শ্রীনগরের ভাগ্যকুল পয়েন্টে পদ্মার পানি পাঁচ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপত্সীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মাওয়া পয়েন্টে দুই সেন্টিমিটার বেড়ে বিপত্সীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
শরীয়তপুরের নড়িয়া-জাজিরা এবং ভেদরগঞ্জের পদ্মার তীর তলিয়ে নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে তিন উপজেলার ১৩ হাজার পরিবারের প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। বর্ষার পানিতে নদীর পার তলিয়ে গিয়ে পদ্মার ডান তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজের বেশ কিছু সাইডে পানি ঢুকে কয়েকটি সাইডের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফরিদপুরে পদ্মার পানি গতকাল রবিবার এক সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১০৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানির চাপে ধসে গেছে সদরের আলিয়াবাদ ইউনিয়নের শহর রক্ষা বাঁধের ১০০ ফুট অংশ। এদিকে ফাটল দেখা দেওয়ায় ফরিদপুর-চরভদ্রাসন আঞ্চলিক সড়কে যান চলাচল সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। ফরিদপুরের ৩০টি ইউনিয়নে ২০ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি হয়ে আছে। পদ্মার পানি বাড়ার কারণে রাজবাড়ী সদর, পাংশা, কালুখালী ও গোয়ালন্দে প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গোয়ালন্দ পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্র জানিয়েছে, গতকাল রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে মাত্র এক সেন্টিমিটার পানি কমে বিপত্সীমার ১০৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যেকোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে রেলওয়ের গোয়ালন্দ বাজার স্টেশন থেকে দৌলতদিয়া ঘাট স্টেশন পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার রেলপথ।
এদিকে পদ্মা, ইছামতী ও কালীগঙ্গা নদীর পানি বাড়তে থাকায় ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। দোহারের কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দোহার শহরের কয়েকটি এলাকায়ও বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এদিকে নবাবগঞ্জের কমপক্ষে ৩৫টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে হরিরামপুর উপজেলা পরিষদসহ গ্রামীণ জনপদ। এ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। সড়ক ও বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে পানি। ডুবে আছে জমির ফসল, ভেসে গেছে মাছ। পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে উপজেলার প্রায় ২০ হাজার পরিবার।
জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি আরো পাঁচ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জেলার সাত উপজেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে শেরপুর সদর ও নকলার চরাঞ্চলের আট ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নকলার রেহাই অষ্টাধর গ্রামে শুরু হয়েছে নদীভাঙন। বন্যায় শেরপুর সদর, নকলা ও শ্রীবরদীর ১৩টি ইউনিয়নের ৫০ গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে।
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর বৈরান নদের মুশুদ্দি কসাইবাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও মুশুদ্দি বাজারসংলগ্ন গাইডওয়াল ভেঙে ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে চলতি আমন মৌসুমের বীজতলা ও শত শত একর সবজি ফসল, মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বিভিন্ন গ্রামের কয়েক শ পরিবার।
এদিকে চাঁদপুরে পদ্মা নদীর অব্যাহত ভাঙনে দিশাহারা রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের কয়েকটি চরের মানুষ। ভিটেবাড়ি হারিয়ে কোথায় যাবে—এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের এখন দিন কাটছে। রবিবারও আরো কয়েক শ পরিবারের শেষ সম্বল বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে গত ১২ ঘণ্টায় ২২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। তবে এখনো পানি বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। পানি বাড়ার কারণে তৃতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বরাক নদের পানি উপচে মৌলভীবাজারের খলিলপুর ইউনিয়নের পাঁচ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।