এ যাত্রায় রক্ষা মেয়র জাহাঙ্গীরের, পাচ্ছেন ‘কড়াবার্তা’

বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করলেও এ যাত্রায় শাস্তির হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের (জিসিসি) মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। শাস্তি না দিলেও তাকে ‘কড়া সতর্কবার্তা’ দিচ্ছে দল। অবশ্য তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আগামী ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে।

আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, কটূক্তি ও অন্যান্য বিতর্কমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দলের দেওয়া শোকজের জবাব গত ১৭ অক্টোবর দিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। সেখানে তিনি ‘তার বক্তব্যকে কেটে কেটে সুপার এডিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে’ বলে দাবি করেছেন। পাশাপাশি ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনিচ্ছাকৃত’ এ পরিস্থিতির জন্য দলীয় সভাপতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।

এরই মধ্যে তার চিঠি দলের হাইকমান্ডে পৌঁছেছে। তারা জবাব পড়েছেন, পর্যালোচনাও করেছেন। দলের নেতারা বলছেন, শোকজের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে নিরপরাধ বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। যেহেতু বিষয়টি সেনসেটিভ (স্পর্শকাতর) এবং দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী এতে ক্ষুব্ধ, তাই তাকে ‘কড়া সতর্কবার্তা’ দেওয়া হতে পারে।

যদিও গত ২১ অক্টোবর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে জাহাঙ্গীরের বক্তব্যের বিষয়টি উঠে এলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এমন বক্তব্য দিতে পারেন না; এটা অপ্রত্যাশিত। শুধু আওয়ামী লীগের নেতা কেন, দলের বাইরের কোনো ব্যক্তিও এমন বক্তব্য দেবেন বলে আমি মনে করি না। এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দলের কার্যনির্বাহী সংসদে আলোচনা করা উচিত।’

এই সূত্র ধরে অনেকে মনে করছেন, জাহাঙ্গীরের জবাবে সন্তুষ্ট নন শেখ হাসিনা। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মতো বহিষ্কার হতে পারেন তিনিও। তবে একাধিক সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর আলমকে এবারের মতো রেহাই দিয়ে ‘কড়া সতর্কবার্তা’ দেওয়া হতে পারে।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘শোকজের জবাব আমরা পেয়েছি। পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন।’

শনিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে আগামী ১৯ নভেম্বর সিদ্ধান্ত হবে।’

আলোচনার শুরু মূলত জাহাঙ্গীর আলমের ঘরোয়া পরিবেশের একটি বক্তব্যের ভিডিও প্রকাশের পর। গোপনে ধারণ করা ১১ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে মেয়র জাহাঙ্গীরকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করতে শোনা যায়। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে সম্পর্ক, হেফাজতের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে তার সখ্য ও রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্যও শোনা যায়।

আওয়ামী লীগ থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কারের দাবিতে গাজীপুরে বিক্ষোভ হয়

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর পর দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গাজীপুর মহানগর। মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়।

গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কিছুদিন গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কোথাও ঝাড়ুমিছিল, কোথাও বিক্ষোভ মিছিলসহ সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেন তারা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী স্টেশন রোড, মিলগেট, চেরাগআলী, কলেজগেট ও হোসেন মার্কেট এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এসব কর্মসূচি পালন করেন।

কিন্তু সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, অডিও-ভিডিও সুপার এডিটিংয়ের মাধ্যমে তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। এমনকি এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

অবশ্য এর মধ্যেই ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ‘স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগে দলের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেওয়া হয়। ১৭ অক্টোবর তিনি সেই শোকজের জবাব দেন।

তার আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ সময়ে জেলা পর্যায়ের একজন নেতার বক্তব্য কাটছাঁট করে এডিট করে দেওয়া হয়েছে কি না দল তা যাচাই-বাছাই করছে।’

জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে গাজীপুরে ঝাড়ুমিছিল করে আওয়ামী লীগের একাংশ

জাহাঙ্গীরের সেই বক্তব্য ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বক্তব্য যেটা আসছে, এটা তো একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের একটা গাণিতিক হিসাব দিয়ে ৩০ লাখকে দুই লাখ প্রমাণ করার চেষ্টা; এ বক্তব্য অবশ্যই প্রত্যেকটি নেতাকর্মীর মনে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সেজন্য তারা এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন।’

তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তিনি বলেছেন, এ বক্তব্য তার নয়। তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন সেটা তার বক্তব্য নয়, তাহলে দেখতে হবে, এটা কে করেছে। তবে আমি তার কণ্ঠ শুনি, জানি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটা তার বক্তব্য।’

আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত ক্লিয়ার, নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। দলের হাইকমান্ড তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্নভাবে আমাদের বক্তব্য শুনতে চেয়েছেন, আমরাও আমাদের বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছি। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র আছে, সে মোতাবেক নিশ্চয়ই দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবে।’

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলমকে পাওয়া না গেলেও তার একাধিক অনুসারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামনে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও সিটি নির্বাচন। যে কারণে একটি পক্ষ মেয়রকে ঘায়েল করতে এপথ বেছে নিয়েছে। এরই মধ্যে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর শোকজের জবাবে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। আশা করি, দলের সিদ্ধান্ত এলে সবই পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top