দাপট দেখিয়ে একম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ

৩০৭ রানের বিশাল লক্ষ্য। বাংলাদেশের বোলিংয়ের সামনে এতবড় লক্ষ্য পাড়ি দেয়া অসম্ভব। এমনটা ধারণাই ছিল। শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজ, তাসকিন, সাকিব, শরিফুল এবং মেহেদী হাসান মিরাজরা সে ধারণাই সত্যি প্রমাণ করলেন।

চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আফগানিস্তানকে ৮৮ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। সে সঙ্গে তিন ম্যাচের সিরিজ ১ ম্যাচ হাতে রেখেই জিতে নিয়েছে টাইগাররা।

জিতলেই মিলবে বিশ্বকাপ সুপার লিগে প্রথম দল হিসেবে একশ পয়েন্ট অর্জনের গৌরব- এমন হাতছানি সামনে রেখে খেলতে নেমে ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত প্রদর্শনী করলো বাংলাদেশ দল। আফগানিস্তানকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে সুপার লিগে সেঞ্চুরির পাশাপাশি পয়েন্ট টেবিলেও শীর্ষস্থান দখল করেছে টাইগাররা।

লিটন দাসের সেঞ্চুরি ও মুশফিকুর রহিমের হাফ সেঞ্চুরিতে ভর করে ৩০৬ রানের বড় সংগ্রহ পেয়েছিল বাংলাদেশ দল। জবাবে ৪৫.১ ওভারে ২১৮ রানেই অলআউট হয়ে গেছে আফগানরা। ফলে ৮৮ রানের বড় জয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজও জিতে নিলো স্বাগতিক বাংলাদেশ।

এ জয়ের পর সুপার লিগে ১৪ ম্যাচে ১০ জয়ে ১০০ পয়েন্ট নিয়ে এক নম্বরে উঠে গেলো তামিম ইকবালের দল। দুই নম্বরে থাকা ইংল্যান্ডের ঝুলিতে রয়েছে ১৫ ম্যাচে ৯৫ পয়েন্ট। সোমবার সিরিজের শেষ ম্যাচ জিতলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংলিশদের চেয়ে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ দল।

বাংলাদেশের করা ৩০৬ রানের জবাবে খেলতে নেমে পাওয়ার প্লে'র দশ ওভারেই ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে আফগানিস্তান। হাঁটুর চোটের কারণে দীর্ঘসময় মাঠের বাইরে থাকা রহমানউল্লাহ গুরবাজকে ওপেনিংয়ে পায়নি আফগানরা। তার জায়গায় ইনিংস সূচনা করেন রহমত শাহ।

ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই সরাসরি থ্রোয়ে উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। ইব্রাহিম জাদরানের জায়গায় একাদশে সুযোগ পাওয়া রিয়াজ হাসান করেন ১ রান। অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহিদিকে কট বিহাইন্ড করেন শরিফুল ইসলাম। হাশমতের ব্যাট থেকে আসে ৫ রান।

পাওয়ার প্লে'র শেষ ওভারে সাকিব আল হাসানের বলে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়েন ৯ রান করা আজমতউল্লাহ ওমরজাই। এরপর চতুর্থ উইকেট জুটিতে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন রহমত ও নাজিবউল্লাহ। এ দুজন মিলে গড়েন ৮৯ রানের জুটি। নাজিবের স্ট্রেইট ড্রাইভে ননস্ট্রাইক প্রান্তে স্ট্যাম্প ভাঙলে মাঠে দেখা যায় অনন্য এক ঘটনা।

শেষ পর্যন্ত এ জুটি ভাঙেন তাসকিন। ইনিংসের ২৫তম ওভারে তাসকিনের বলে সোজা বোল্ড হয়ে যান ৫২ রান করা রহমত। পরে ২৯তম ওভারের প্রথম বলে আরেক হাফসেঞ্চুরিয়ান নাজিবকে উইকেটের পেছনে ক্যাচে পরিণত করেন তাসকিন। নাজিবের ব্যাট থেকে আসে ৫৪ রান।

নাজিবের বিদায়ের পর উইকেটে আসার অনুমতি পান গুরবাজ। তবে বেশিক্ষণ থাকা হয়নি তার। সাকিবের বলে প্লেইড অন হওয়ার আগে ৭ রান করতে পেরেছেন এ উইকেটরক্ষক ব্যাটার। সবশেষ ৩৮তম ওভারে অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবিকে সাজঘরে পাঠিয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। নবির ব্যাট থেকে এসেছে ৩২ রান।

নবির বিদায়ের পরই মূলত জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের। মোস্তাফিজুর রহমানের এক ওভারে পরপর ছয় ও চার মেরে খানিক আশা জাগান রশিদ খান। তবে পরের বলেই তাকে বোল্ড করে দেন মোস্তাফিজ। আউট হওয়ার আগে রশিদ খেলেছেন ২৬ বলে ২৯ রানের ইনিংস।

এরপর বাকি ২ উইকেট নিয়ে জয়ের বাকি আনুষ্ঠানিকতা সারতে লেগে যায় আরও ৪.৪ ওভার। শেষ দুই উইকেটই নেন দুই খণ্ডকালীন বোলার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও আফিফ হোসেন ধ্রুব। প্রথমে মাহমুদুল হাসান জয়ের দারুণ এক ক্যাচে সাজঘরে ফেরেন ফরিদ উদ্দিন মালিক।

পরে ৪৫তম ওভারে প্রথমবারের মতো আক্রমণে এসে প্রথম বলেই মুজিব উর রহমানকে বোল্ড করে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। আগের ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ে আফিফই নিয়েছিলেন উইনিং শট। আজ জয় নিশ্চিত করা শেষ উইকেটও এলো আফিফের হাত ধরে।

আজ বল হাতে দুর্দান্ত ছিলেন তাসকিন আহমেদ। দশ ওভারের স্পেলে ছিল দুইটি মেইডেন, মাত্র ৩১ রান খরচায় তিনি ফিরিয়ে দেন আফগানদের দুই হাফসেঞ্চুরিয়ান রহমত ও নাজিবকে। এছাড়া সাকিব ৩৮ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট। বাকি পাঁচ উইকেটে ভাগ বসিয়েছেন মোস্তাফিজ, শরিফুল, মেহেদি মিরাজ, মাহমুদউল্লাহ ও আফিফ।

এর আগে টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার সময় বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল বলেছিলেন, ২৬০ রান করলেই জয়ের জন্য যথেষ্ট হবে মনে করেন তিনি। লিটন-মুশফিকের দাপুটে ব্যাটিংয়ে অধিনায়কের চাওয়া পেরিয়ে আরও ৪৬ রান বেশি করেছে বাংলাদেশ।

দলকে বিশাল সংগ্রহ এনে দেওয়ার পথে তৃতীয় উইকেটে ২০২ রানের জুটি গড়েছেন মুশফিক ও লিটন। যা তৃতীয় উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি রেকর্ড। এছাড়া সবমিলিয়ে যেকোনো উইকেটে পঞ্চম সর্বোচ্চ রানের জুটি এটি। এ নিয়েই পঞ্চমবারই কোনো উইকেটে ২০০ রানের জুটি দেখলো বাংলাদেশ।

সবশেষ পাঁচ ইনিংসের মধ্যে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া লিটন খেলেছেন ১২৬ বলে ১৩৬ রানের ইনিংস। যেখানে ছিল ১৬ চার ও দুইটি বিশাল ছয়ের মার। অন্যদিকে ক্যারিয়ারের ৪১তম ফিফটি করা মুশফিকের ব্যাট থেকে এসেছে ৯ চারের মারে ৯৩ বলে ৮৬ রান।

বাংলাদেশের সংগ্রহ আরও বড় হতে পারতো। কিন্তু লিটন-মুশফিকের বিদায়ের পর রানের চাকা সচল রাখতে পারেননি আফিফ হোসেন ধ্রুব ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এ দুজনের জুটিতে শেষ ২১ বলে এসেছে মাত্র ২১ রান। যেখানে ছিল মাত্র ১টি বাউন্ডারি। স্লগ ওভারে এমন ধীর ব্যাটিংয়ের কারণেই মূলত ৩০৬ রানের বেশি যায়নি বাংলাদেশের ইনিংস।

ম্যাচে টস জিতে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের কাজ অর্ধেক সহজ করে দিয়েছিলেন আফগান বোলাররাই। প্রথম দশ ওভারে তারা অতিরিক্ত রানই ২০টি। যে কারণে শুরুতে রানরেট নিয়ে ভাবতেই হয়নি বাংলাদেশকে। অবশ্য তাতেও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি তামিম। লিটনের সঙ্গে তার উদ্বোধনী জুটিতে এসেছিল ৩৮ রান।

আজও ফজল হক ফারুকির প্রায় একই ডেলিভারিতে আউট হয়েছেন তামিম। ইনিংসের সপ্তম ওভারের দ্বিতীয় বলটি ছিল ভেতরে ঢোকা ডেলিভারি। বলের লাইন কভার করতে পারেননি তামিম, যা আঘাত হানে প্যাডে। রিভিউ নিয়েও নিজের উইকেট বাঁচাতে পারেননি তিনি। আউট হওয়ার আগে করেন ২৪ বলে ১২ রান।

ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে চার মেরে রানের খাতা খুলেছিলেন তামিম। তিনি ফেরার ঠিক পরের বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে যাত্রা শুরু করেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু তিনিও বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। লিটন দাসের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে ৪৫ রান যোগ করেন রশিদ খানের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন ২০ রান করা সাকিব।

সাকিবের আগে লিটনের ইনিংসেও রানের খাতা খুলেছিল চারের মারে। তবে তামিম-সাকিব না পারলেও বড় ইনিংস এসেছে এ ডানহাতি ওপেনারের ব্যাট থেকে। ফারুকি ও মুজিব উর রহমানের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে শুরুতে হাত খুলে খেলতে পারেননি লিটন। যে কারণে ফিফটি করতে লেগে যায় ৬৫ বল। তবে পঞ্চাশ থেকে একশতে পৌঁছতে তিনি নিয়েছেন মাত্র ৪২ বল।

সবমিলিয়ে ১০৭ বলেই করে ফেলেছেন ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরি। এ নিয়ে নিজের শেষ পাঁচ ম্যাচের মধ্যে দুইটি সেঞ্চুরি করলেন লিটন। গত জুলাইয়ে সবশেষ ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ১০২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন লিটন। পরের তিন ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ২১, ৩২ ও ১ রান। আজ ফের দেখা পেলেন জাদুকরী তিন অঙ্কের।

লিটনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রান করছিলেন মুশফিকও। তিনি ফিফটিতে পৌঁছতে খেলেন মাত্র ৫৬ বল, যেখানে ছিল ৬টি চারের মার। আর ফিফটি ছোঁয়ার পথে ৪৭তম রান নিয়ে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডে সাকিবকে ছাড়িয়ে যান এ অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক ব্যাটার।

মনে হচ্ছিল, লিটনের মতো মুশফিকের ব্যাট থেকেও আসবে সেঞ্চুরি। কিন্তু একই ওভারে দুজনকে সাজঘরে পাঠিয়ে দেন ফরিদ উদ্দিন মালিক। ইনিংসের ৪৬তম ওভারের দ্বিতীয় বলে স্লোয়ার ডেলিভারিতে বড় শট খেলতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ধরা পড়েন লিটন। তার ব্যাট থেকে আসে ১৬ চার ও ২ ছয়ের মারে ১৩৬ রানের ইনিংস।

ঠিক পরের ডেলিভারি ছিল স্লোয়ার বাউন্সার। আপার কাট করে থার্ড ম্যানে দাঁড়ানো ফারুকির হাতে ধরা পড়েন ৮৬ রান করা মুশফিক। লিটনের সঙ্গে তার তৃতীয় উইকেট জুটির সংগ্রহ ছিল ২০২ রান। এরপর শেষের ২১ বল থেকে মাত্র ২১ রান নিতে পারেন আফিফ ও মাহমুদউল্লাহ। আফিফের ব্যাট থেকে আসে ১২ বলে ১৩ রান, মাহমুদউল্লাহ করেন ৯ বলে ৬ রান।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top