পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য ছিল বগুড়া। উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু এ জেলার বড় অপরাধের গোড়াই ছিল চাঁদাবাজি। বাস, ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে বগুড়া জেলা শহর ও এর আশপাশে ২৪ ঘণ্টা চাঁদা তুলতো ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা। এ তিন ধরনের পরিবহন থেকে বছরে চাঁদাবাজির পরিমাণ প্রায় ৮০ কোটি টাকা। বর্তমানে পুলিশের কঠোরতায় প্রকাশ্যে না চললেও গোপনে চাঁদাবাজির ঠিকই চলছিল। এ কারণেই এখানকার পরিবহন খাতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া ক্ষমতাসীন দলের একাধিক গ্রুপ।
প্রথম খবরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদাবাজির খাত তৈরি করতে বিভিন্ন সময় রাস্তায় নামানো হয়েছে হাজার হাজার অবৈধ যানবাহন। চাঁদার সিন্ডিকেটের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ যুবলীগের হাতে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি আর শ্রমিক লীগের তিনটি গ্রুপও রয়েছে। বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপের দখল নিয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও মারপিটের ঘটনার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
জানা গেছে, পরিবহনে চাঁদা আদায়ে বগুড়ার ইতিহাস দীর্ঘ সময়ের। শুরু থেকেই কে কোন অঞ্চল থেকে চাঁদা তুলবে তা নিজেদের মতো ঠিক করা রয়েছে। কেউ কারো অঞ্চলে যায় না। এক দল এক অঞ্চল বেছে নিয়েছে তো আরেক দল নিয়েছে ভিন্ন অঞ্চল। ফলে পুরো বগুড়ায় চলেছে এক ধরনের সমঝোতাপূর্ণ চাঁদাবাজি।
বগুড়ার বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার অপরাধ জগতের সঙ্গে এই চাঁদাবাজির যোগসূত্র রয়েছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অনেকে খুন, মাদক, চোরাচালান, অবৈধ দখলসহ নানা অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত। অন্য যেকোনো জেলার চেয়ে বগুড়ার চাঁদাবাজির পার্থক্য হচ্ছে- উত্তরবঙ্গের ১১ জেলার প্রবেশ দ্বার এই জেলা। অর্থাৎ ঢাকা থেকে ১১ জেলায় যেতে এবং ওই জেলাগুলো থেকে ঢাকায় আসতে বগুড়ার ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। সেক্ষেত্রে শহরতলীর চারমাথা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও মোটর মালিক বা শ্রমিক গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার করা জরুরি।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বগুড়া জেলা মোটর মালিক গ্রুপের নেতৃত্ব নিয়ে সংঘর্ষে পুলিশ সাংবাদিকসহ ১৫ জন আহত হয়। যুবলীগের ক্যাডাররা ছুরিকাঘাত করে পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্যকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে। শহরতলীর চারমাথা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল চত্বরে সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে। বগুড়া জেলা মোটর মালিক গ্রুপের নেতৃত্ব নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহনের সঙ্গে সদর উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ও পৌর কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামের দ্বন্দ্বের জেরেই হামলার ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
জানা গেছে, জেলা পুলিশের কঠোরতার কারণে মহাসড়কে এখন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি হচ্ছে না। তবে গোপনে সক্রিয় রয়েছে। এখানে আগে থেকেই প্রতিটি বাসের নির্ধারিত চাঁদার পরিমাণ ৪৫০ টাকা। এ হিসাবে দুই হাজার বাস থেকে চাঁদা উঠতো দিনে ৯ লাখ টাকা। শুধু বাস থেকেই বছরে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রায় সমপরিমাণ চাঁদা আদায় হতো পণ্যবাহী ট্রাকগুলো থেকেও। সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকেও আদায় হতো বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
আদায় বিভাজনে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক ব্যয় দেখানো হতো ২০০ টাকা, আন্তঃজেলা কোচ ছাড়পত্র ৭০ টাকা, বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপ ৫০ টাকা, পৌর টোল ৫০ টাকা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন বিভাগীয় কমিটি ২০ টাকা, শ্রমিক কল্যাণ চাঁদা ২০ টাকা, বগুড়া কোচ মাইক্রো ও শ্রমিক ইউনিয়ন ৩০ টাকা।
বগুড়া হয়ে দিনে অন্তত তিন হাজার ট্রাক চলাচল করে। প্রতি ট্রাক থেকে চাঁদা নেয়া হতো ৩০০ টাকা। সেই হিসাবে ট্রাক থেকেও বছরে নেয়া হয় প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি টাকা।
বগুড়া জেলা শ্রমিক লীগ ও মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দিন শেখ হেলাল বলেন, আগে শ্রমিকদের কল্যাণে চাঁদা তোলা হতো। এই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের বিপদে সহায়তা করা হতো।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম দাবি করেন, তিনি এসবের কিছুতে নেই। তবে তিনি নিজেও মোটর মালিক। স্বাভাবিক কারণেই তিনি সবসময় চেয়েছেন মোটর মালিক গ্রুপটি কোনো বিতর্ক ছাড়া সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে চলুক।
বগুড়া শহরে নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশা রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার। আর জেলায় অনিবন্ধিত রয়েছে আরও সাড়ে ১৪ হাজার। মালিক সমিতির সদস্য হতে চাঁদা লাগে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া দৈনিক চাঁদা ২০-৫০ টাকা। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং শ্রমিক লীগের নেতারা। তবে তারাও এলাকা ভাগ করে নিয়েছেন। পুরো বিষয়টি আবার নিয়ন্ত্রণ করে মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। অর্থাৎ তিন চাকার সিএনজি অটোরিকশাও এখন মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন।
দেখা গেছে, সর্বনিম্ন ২০ টাকা করে হিসাব করলেও ২০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে দিনে আদায় হয় চার লাখ টাকা, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। চাঁদাবাজির আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এর মধ্যে যুবলীগে রয়েছে দুটি পক্ষ। একপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন। অপরপক্ষ মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ও শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দিন শেখ হেলাল ও সদর উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম।
২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল পরিবহন ব্যবসায়ী ও আইনজীবী মাহবুব আলমকে ছুরিকাঘাতে খুন করে দুর্বৃত্তরা। বিএনপি নেতা মাহবুব আলমের স্ত্রী আকতার জাহান দাবি করেন, পরিবহন ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। শাহীন নিজে বিএনপির রাজনীতি করলেও বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপে আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মোহনের দলের লোক ছিলেন তিনি। হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি হন সদর উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম। আবার গত মঙ্গলবার চারমাথায় মোটর মালিক গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের দুই মামলায় আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মোহনকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শহরকেন্দ্রিক অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করে যুবলীগের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কমিটিগুলো। এর মধ্যে রয়েছে, দত্তবাড়ি স্ট্যান্ডে একটি, চেলোপাড়ার একটি, গোহাইল সড়কের একটি, পূর্ব বগুড়ার একটি ও স্টেশন সড়কে একটি।
দত্তবাড়ি নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ সদস্য মিঠু ও শহর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহিন। চেলোপাড়ায় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে যুবলীগের সদস্য বড় আনন্দ ও সংগ্রামের। সূত্রাপুরের গোহাইল রোডে জেলা যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আলহাজ শেখের নিয়ন্ত্রণে চলে অটোরিকশা।
চারমাথা নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগের সদস্য এরশাদ ও খোরশেদ। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুর রহমান দুলুর নামে শেরপুর সড়কে অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পূর্ব বগুড়া মালিক সমিতির নামে শহর যুবলীগ নেতা আব্দুল মতিন প্রামাণিক নিয়ন্ত্রণ করেন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বগুড়া মালিক শ্রমিক যৌথ সমন্বয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান আকন্দ বলেন, চাঁদা সংগঠনের স্বার্থে উঠলেও সেটির একটি সীমারেখা করা উচিত। কারণ সংগঠন চালাতে গেলে চাঁদার প্রয়োজন আছে। তবে দলীয় ব্যানারে সন্ত্রাসী কায়দায় কোনো সংগঠন দখলে নেয়ার উদ্দেশ্য কখনোই ভালো হতে পারে না।
তিনি স্বীকার করেন যে, বর্তমানে পুলিশের কড়াকড়ির কারণে প্রকাশ্য চাঁদা আদায় বন্ধ থাকলেও নীরবে ঠিকই চলছে।
এ বিষয়ে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, এই মুহূর্তে বগুড়ায় কোনো চাঁদা আদায় করতে দেয়া হয় না। আগেও যে চাঁদা উঠতো সেটাও তোলা হতো মালিক শ্রমিক সংগঠনের নামে। এখন অন্যায়ভাবে চাঁদা নেয়া হলে যে কেউ অভিযোগ দিতে পারেন। তখন আমরা ব্যবস্থা নেব।