কুমিল্লায় ১৮ করোনা রোগীর চিকিৎসা করে সাড়ে ৫ কোটি টাকা দাবি!

২২ দিনে মাত্র ১৮ জন করোনা আক্রান্তকে চিকিৎসার জন্য আইসিইউ ফ্লোর ব্যবহার করতে দিয়ে কুমিল্লার এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার ৫৮৭ টাকা বিল দাবি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। এর মধ্যে স্টাফদের বেতন বাবদ দাবি করা হয় ৪১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৭৯ টাকা! প্রতি করোনা রোগী আইসিইউ চিকিৎসা বাবদ দাবি করা হয়েছে গড়ে ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ৩২ টাকা।

অথচ ঐ হাসপাতালে সকল চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফ দিয়ে করোনা আক্রান্তদের আইসিইউ সেবা দিয়েছে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফোরটিস হাসপাতালের শুধু আইসিইউ ইউনিটের ফ্লোর ও ইউটিলিটি সুবিধা ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। ফোরটিস কাণ্ড এখানেই শেষ নয় তারা প্রত্যেক রোগীর আলাদা আলাদা বিল বানিয়ে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছেও ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৩৬ টাকা বিল দাখিল করেছে! সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। সূত্র জানায়, ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালের এই বিল পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছে। 

সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে কুমিল্লা জেলা স্বাস্থ্য কমিটি প্রথমে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভবনটিকে করোনা চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু ৫০০ শয্যার কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় কুমিল্লা জেলা স্বাস্থ্য কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয় যতদিন না সেখানে আইসিইউ বেড স্থাপন না করা হয় ততদিন কুমিল্লা শহরের আড়াইওড়াস্থ এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালের ৯টি সিসিইউ বেডকে আইসিইউতে রূপান্তর করে সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুজিবুর রহমানের তত্বাবধানে ১০ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালে ১৮ জন করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগী আইসিইউ সেবা নেন।

এই ১৮ জন রোগীর মধ্যে রয়েছেন মো. লিমন, বশিরুল ইসলাম, জুনায়েদ করিম রাহাত, আতিকুর রহমান, মিজানুর রহমান, হালিমা খাতুন, মমিন আহমেদ, আরিফুর রহমান, আরিফুর রহমান (২), সুনীল চন্দ্র দে, জহিরুল ইসলাম রতন, আনোয়ার আমিন, হেদায়েত উল্লাহ, আক্তার জাহান জোৎস্না, তাহমিনা আক্তার, সামিয়া আক্তার, মো. রউফ। গত ৩ জুন থেকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা আক্রান্তদের জন্য আইসিইউ সেবাসহ পূর্ণাঙ্গ করোনা ইউনিট চালু করা হয়। এরপর ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আইসিইউ খরচ বাবদ ৫ কোটি ৬ লাখ ৮২ হাজার ৮০৮ টাকা এবং স্টাফদের বেতন বাবদ ৪১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৭৯ টাকাসহ মোট ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার ৫৮৭ টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়ার জন্য বিল দাখিল করে। 

কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুজিবুর রহমান জানান, ২২ দিন চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফ আমরা (কুমেক হাসপাতাল) দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে তারা দায়িত্ব পালন করেছে। ৩ জুন কুমেক হাসপাতালে করোনা ইউনিট চালুর সময় ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার তাদেরকে জানিয়ে দেন করোনা প্রতিরোধে জেলা স্বাস্থ্য কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ি তাদের হাসপাতালের আইসিইউ ব্যবহার করা হয়েছে। মানবতার সেবা দেওয়া তাদেরকে ধন্যবাদ জানানো হয় এবং বলা হয় সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ি কোন বিল দেওয়ার কথা হয়নি বা চুক্তিও হয়নি। বিষয়টি এখানেই শেষ।

তিনি জানান, ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার সময় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার প্রদান করেন। 

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের পরিচালকের কাছে দাখিল করা আর্থিক অনুদানের বিলের বিষয়ে স্মারক নং স্বা: অধি:/হাস:/কভিড ১৯/হাসপাতাল রূপান্তর/করোনা ফাইল নং ৩/২০২০/৬৭২ নম্বর স্মারকে এই অনুদানের বিষয়ে কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামানের মতামত চায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

১৪ জুন সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান তার লিখিত মতামতে জানান, করোনা প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ি ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালকে নির্বাচন করা হয়। পরবর্তীতে কুমিল্লা বিএমএ ও স্বাচিপ কর্তৃক গঠিত আইসিইউ/সিসিইউ টিমের সদস্যরা ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদান শুরু করে, যার জন্য তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানানো হয় এবং সংশ্লিষ্ট সকলের বেতন ভাতাদি কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার পরিশোধ করেন। 

কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান জানান, তাদেরকে ওষুধ, সুরক্ষা সরঞ্জাম সব আমরা দিয়েছি। যারা চিকিৎসা দিয়েছে তাদেরকে কুমিল্লা ক্লাব ও ভিক্টোরি হাসপাতালে রেখেছি। ৩ জুন কুমেক হাসপাতালে করোনা ইউনিট চালুর সময় ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানানো হয়। এরপর তাদের এই দাবি বিশ্ময়ের, বেদনার উদ্বেগের। এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। 

এক দিকে যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবিকৃত ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার ৫৮৭ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন তখন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ৯ জুন ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. সৈয়দ আহমদ ও কনসালটেন্ট ডা. মো. রাসেল আহমেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত আরেকটি বিল দাখিল করা হয়। তাতে ১২ রাখ ৭৫ হাজার ৬৩৬ টাকা বিল দাবি করা হয়। এ বিল দাবি করা হয় প্রত্যেক রোগীর বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে উল্লেখ করে। এই ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে শুধু বেড ভাড়া ৬ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা ধরা হয়। করোনা আক্রান্ত দরিদ্র রোগী মুরাদনগরের লিমনের বেড ফি বাবদ এক লাখ ৪ হাজার ৫ শ টাকাসহ ১ লাখ ৭ হাজার ৯৫০ টাকা বিল ধরা হয়। 

ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. মো. রাসেল আহমেদ চৌধুরী জানান, প্রধান শাখা থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দাখিল করা বিলের বিষয়ে আমরা কিছুরই জানি না। তিনি জানান, কুমিল্লায় যাদের সেবা দিয়েছি তাদের বিষয়ে আমরা কুমিল্লায় বিল দাখিল করেছি। স্থানীয়ভাবে আমরা বিল দিয়েছি। রোগীদের আমরা খাবার দিয়েছি, ওষুধ দিয়েছি, অক্সিজেন দিয়েছি। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যেটা দিয়েছে সেটা প্রধান কার্যালয় থেকে দিয়েছে, আমরা কিছু জানি না। 

স্থানীয়ভাবে কুমিল্লায় দাখিল করা বিল সম্পর্কে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুজিবুর রহমান জানান, তাদের দাখিল করা হাস্যকর বিলের কারনে বিলগুলো দেখার ইচ্ছাও হয়নি। মুরাদনগরের একজন দরিদ্র রোগীর বিল করেছে একলাখ টাকার বেশি। অক্সিজেন, ইউটিলিটি বিলটা দেওয়া যেতে পারে। 

এদিকে ফরটিস হার্ট ইন্সটিটিউট জিএম অপারেশন তৌফিক হাসান সাংবাদিকদের জানান, কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কভিড ইউনিট চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালটি ব্যবহার করা হয়েছে। অক্সিজেন ব্যবহার করেছি। বিল পরিশোধের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। 

এদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে কুমিল্লা শহরের আড়াইওড়ায় অবস্থিত ফরটিস হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাইদ। তারা হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিষয় দেখেন। পরে ফার্মেসিতে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষধ পায়। তাছাড়া আমদানি বহির্ভূত ও নিবন্ধনবিহীন ওষধ পায়। এজন্য ফরটিস হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মেসিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি। 

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাইদ জানান, এ এফ সি ফরটিস হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আসে। এখানে অনিয়ম হয়েছে। এই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে মূলত এই হাসপাতালে পরিদর্শনে আসি। পরিদর্শনে এসে বেশ কিছু বিষয় আমাদের অবজারভেশনে আসে। সব থেকে বেশি হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মেসিতে। অনেক মালামাল জব্দ করেছি। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ, সেম্পল যেগুলো আমদানী বহির্ভূত ওষুধ, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ওষুধ। এই বিষয়গুলো আমলে নিয়েছি। তারা কোনো সদোত্তর দিতে পারেনি। যার কারণে ওষুধ আইন ১৯৪৪ এর ২৭ ধারা মোতাবেক ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে কারাদণ্ড প্রদানের আদেশ দেওয়া হয়। যেহেতু  তারা তৎক্ষণাৎ অর্থ পরিশোধ করেছে সেহেতু কারাদণ্ড হবে না। এ ছাড়া আমরা আরো কিছু বিষয় অবজারভেশনে দিয়েছি।

কুমিল্লার বেসরকারি হাসপাতাল ফরটিসের যখন এই কাণ্ড তখন কুমিল্লার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোর মালিকরা সরকারি প্রশাসনকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ি ৫০ শয্যা ও তদোর্ধ হাসপাতালে কভিড ও নন কভিড উভয় ধরনের চিকিৎসা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার নির্দেশনা থাকলেও তাদের হাসপাতালে কোন করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে কিনা তা কারো জানা নেই। জানা নেই কুমিল্লা সিভিল সার্জন কার্যালয়েরও। কুমিল্লার সিভিল সার্জন অফিস কুমিল্লার তিনটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক মালিকদের তিন দফা চিঠি দিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে কিনা জানাতে বললেও তারা কোন চিঠির জবাব দেয়নি। 

কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান জানান, সবাইকে তিন দফা চিঠি দিয়েছে। সবশেষ ১২ জুলাই চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো জবাব দিচ্ছে না। 

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top