লাগামহীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল, নিয়ন্ত্রণে কড়া হচ্ছে হাইকমান্ড

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ১৩ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার ধুনটে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়

## ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড
## অকার্যকর শোকজ-বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা
## দুশ্চিন্তা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূলে দ্বন্দ্ব-বিভাজন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। দলটি গ্রুপ-সাব গ্রুপে বিভক্ত জেলা-মহানগর থেকে উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যন্ত। স্বার্থের প্রয়োজনে সংঘাতে জড়ানোর নজিরও মিলছে বহু। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনের প্রার্থিতা নিয়ে এ বিভাজন বেশি স্পষ্ট হয়েছে। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী দেয়া, নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বাকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।

 বড় দলে এরকম হয়ই। তবে আমাদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের নির্দেশনা হলো, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে সবাই মিলে কাজ করতে হবে 

সারাদেশে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় টিম। খোদ সাধারণ সম্পাদক (ওবায়দুল কাদের) বিদ্রোহী প্রার্থীদের কেন্দ্রে তলব করেও এসবের সুরাহা করতে পারেননি। অনেক জায়গায় প্রার্থী ও নেতাদের আচরণে বিব্রত কেন্দ্রই বরং পিছু হটেছে। বাকি পৌরসভা ও আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন নিয়েও একই দুশ্চিন্তা আওয়ামী লীগের।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বড় দলে এমন হয়ই। তাদের নয়া কৌশল আছে, যেটার প্রতিফলন শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে এটার আরও প্রতিফলনে এই পরিস্থিতি থাকবে না।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, টানা ১২ বছর ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দু-তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এমপির (সংসদ সদস্য) এক গ্রুপ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের আরেক গ্রুপ, এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতা থাকলে তার নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ দেখা যাচ্ছে। জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদেরও অনেক জায়গায় পৃথক গ্রুপ আছে। নিজ গ্রুপ ভারী করতে যাচাই-বাছাই ছাড়াই নেতারা অনেককে দলে ভেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা। তারা গা বাঁচাতে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ছে। এর প্রভাবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপি-জামায়াত দৃশ্যত মাঠে না থাকায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্বই বারবার চোখে পড়েছে। এ নিয়ে নেতাদের বাকযুদ্ধেও বেশ বিব্রত দলের হাইকমান্ড।

দলীয় সূত্র বলছে, নেতাদের লাগামহীন গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত রুখতে তলব, শোকজ ও বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমান্ড। কিন্তু তাতেও ফল মিলছে না।

 যারা বিদ্রোহী হয়েছেন, তাদের মদদদাতাদেরও এই শাস্তির আওতায় আনা হবে 

গত ৬ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী মশিউর রহমান সবুজকে ঢাকায় দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে তুলে নিয়ে আসার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার প্রতিবাদে থানা ঘেরাও করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন সবুজের সমর্থকরা। এতে দলীয় প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে সংঘাতে অন্তত অর্ধশত আহত হন। এতেও দমানো যায়নি সবুজকে। এলাকায় ফিরে তিনি পরদিনই নির্বাচনী মাঠে থাকার ঘোষণা দেন। যদিও গত ১১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন (ইসি) কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই কালকিনি পৌরসভা নির্বাচন স্থগিত করে ।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষ হয়। এতে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন । নিহত মো. খলিল (৩৫) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিনের সমর্থক ছিলেন।

এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের মতো পরিবেশ দেখা যায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই নৌকার প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা যেন বিরোধী দল হয়ে উঠেছিলেন। স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তিনি দলের কড়া সমালোচনা করেন। ‘অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বলায় জাতীয়ভাবে আমাকে উন্মাদ বলা হয়’, ‘অস্ত্র তাক করে রেখেছে, আমাকে মেরে ফেলতে পারে’, ‘কেউ মারা গেলে ডিসি, এসপি ও রিটার্নিং কর্মকর্তার রেহাই নেই’, ‘অনেক বিপদে আছি, চাপে আছি, রাতে আমার ঘুম হয় না’—কাদের মির্জার এমন কিছু বক্তব্য জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে রাখে বেশ কিছুদিন। এ নিয়ে বিব্রত হয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচন শেষ হলেও কাদের মির্জাকে নিয়ে আলোচনা থামেনি। মেয়র পদে শপথ নিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে তার গাড়িবহরে হামলাসহ নানা কারণে সে ইস্যু এখনো প্রাসঙ্গিক।

গত বছরের ১০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের প্রভাব খাটানোর বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় সেখানকার নির্বাচন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।

গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র পদে একক প্রার্থী দিয়ে বিপুল ভোটে জিতে গেলেও কাউন্সিলর পদে ধাক্কা খায়। করপোরেশনের ৪২টি ওয়ার্ডের বেশ কয়েকটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন চার বিদ্রোহী।

এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন নগরের পাহাড়তলীতে আপন ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে ভাইয়ের প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটে। নিহত নিজামউদ্দীন মুন্না ১২ নম্বর ওয়ার্ডের (সরাইপাড়া) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী সাবের আহম্মদের কর্মী ছিলেন। ছুরিকাঘাতকারী সালাউদ্দিন কামরুল ১২নং সরাইপাড়া ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আমিনের কর্মী। সেদিন নগরের খুলশী থানার ইউসেপ আমবাগান কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক পথচারী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরও কয়েকজন।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দেশের ৬০ পৌরসভা নির্বাচনে একক প্রার্থী দিতে পারেনি আওয়ামী লীগ, যে কারণে আট পৌরসভায় মেয়র পদে নৌকাকে হারিয়ে বিজয় নিশ্চিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী। একইভাবে ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ৬৩টি পৌরসভা নির্বাচনে ১৪টিতে নৌকাকে ডুবিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছে। উপজেলা নির্বাচনগুলোতেও ছিল একই চিত্র।

এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর দ্রোহ-বিদ্রোহের জন্য সব সময় কেন্দ্রকে দায়ী করে আসছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, কেন্দ্র থেকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই কম গ্রহণযোগ্য ও কম জনপ্রিয়দের মনোনয়ন দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় নেতারা দোষেন তৃণমূলের গ্রুপিং বা বিভাজনকে। বাস্তবতা যাই হোক, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বড় দলে এরকম হয়ই। তবে আমাদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের নির্দেশনা হলো, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। তার বিকল্প প্রার্থী হলে বা বিরুদ্ধে গেলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের আর মনোনয়ন দেয়া হবে না।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চেইন অব কমান্ড ঠিকই আছে। কিছু কিছু জায়গায় যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেছেন, তাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে শোকজ বা কোনো জায়গায় বহিষ্কার করা হয়েছে। আবার কাউকে ক্ষমাও করে দেয়া হয়েছে। এখন কিন্তু এ বিষয়ে দলের অবস্থান খুব কঠিন। যারা ইতোমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন বা নিজেই দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কিন্তু সাংগঠনিকভাবে পদ দেয়া ও মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সামনেও তাদের দলীয় কাঠামোয় নিয়ে আসা হবে না বা দলীয় পদ দেয়া হবে না। নির্বাচনেও মনোনয়ন দেয়া হবে না।’

আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আসলে শোকজ বা বহিষ্কারে কোনো ফল আসছে না। এজন্য এবার আমাদের দল নতুন কৌশল নিয়েছে। গত কয়েকটি স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রে আপনারা সেটা হয়তো খেয়াল করেছেন। গতবার যারা বিদ্রোহী ছিলেন, তাদের এবার মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এমনকি যারা বিদ্রোহী হয়ে পাস করেছেন, তাদেরও মনোনয়ন দেয়া হয়নি। ভবিষ্যতেও দেয়া হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে; যারা বিদ্রোহী হয়েছেন, তাদের মদদদাতাদেরও এই শাস্তির আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে যুগ্ম-সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা কাজ করছেন।’

শোকজ-বহিষ্কার বা মনোনয়ন ও দলীয় পদ না দেয়া—যেটাই হোক, বিদ্রোহী ঠেকানোর কৌশল, তৃণমূলের কোন্দল নিরসন জরুরি বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top