চতুর্থ শ্রেণির বইয়ে ‘ভুল’ সাত বছরেও দেখলো না এনসিটিবি!

প্রাথমিক স্তরের চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ে ‘ভুল’ সাত বছরেও দেখতে পায়নি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তথ্যগত এই ভুল নিয়েই বইটির পাঠ দিয়ে আসা হচ্ছে। এত বছরেও ভুলটি জানতে না পারায় তা সংশোধনও করা হয়নি।

অথচ মুদ্রিত পাঠ্যবইয়ে তত্ত্ব ও তথ্যগত ভুল সংশোধন এবং বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বানানরীতি অনুযায়ী বানান সংশোধন করার দায় রয়েছে এনসিটিবির। এরপরও পাঠ্যবইয়ে প্রতিবছরই কোনো না কোনো ভুল হচ্ছেই সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির।

চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইটির ৫৮ পৃষ্টায় দর্শনীয় পাহাড়ি এলাকার বর্ণনায় দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে, ‘সিলেট বিভাগের উত্তরে হিমালয় পাহাড়ের পাদদেশে জাফলং অবস্থিত। এখানে খাসি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আবাসস্থল। এখানে মারী নদী থেকে বয়ে আসে অনেক পাহাড়ি পাথর।’

বইয়ের এই বর্ণনায় দুটি তথ্যগত ভুল রয়েছে। প্রথমত, জাফলং হিমালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নয়। এখানে হবে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়, যার অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। এটিকে মেঘালয় পাহাড়ও বলা হয়। আর এই মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে জাফলং এর অবস্থান।

দ্বিতীয়ত, বইটিতে বলা আছে ‘এখানে মারী নদী থেকে বয়ে আসে পাহাড়ি পাথর।’ অথচ ‘মারী’ নামে সিলেট বিভাগে কোনও নদীই নেই। ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী এবং নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে ‘সারি’ নামক একটি নদী রয়েছে সেখানে।’

বইটি রচনা ও সম্পাদনা করেছেন, ড. মাহবুবা নাসরীন, ড. আব্দুল মালেক, ড. ইশানী চক্রবর্তী ও ড. সেলিনা আক্তার। আর বইটির পরিমার্জনকারীরা হলেন, লানা হুমায়রা খান, মো. মোসলে উদ্দিন সরকার, মো. মোস্তফা সাইফুল আলম, মো. আবু সালেক খান।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরই বই পরিমার্জন করা হয়। অথচ গত ৭ বছর ধরে বইটির এই ভুল চোখে পড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এমনকি সিলেট কিংবা সেই গোয়াইনঘাট উপজেলার স্কুলগুলোর শিক্ষক কিংবা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কারও নজরেও পড়েনি এতদিন।

গোয়াইনঘাট আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আহমদ আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জাফলংয়ের বর্ণনায় যে এমন ভুল তথ্য দেওয়া আছে এটা জানতামই না। এখানে মারী নদী নামের কোনও নদীর অস্তিত্ব নেই। এমনকি হিমালয়ের পাদদেশে জাফলং এর অবস্থানও নয়।’

গোয়াইনঘাট উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. ইকবাল মিয়া প্রথম খবরকে বলেন, ‘বইয়ের দুটো শব্দই ভুল। জাফলংয়ে সারি নামক নদীটি স্পর্শও করেনি। সারি নদীটি পাশের উপজেলা জৈন্তা দিয়ে প্রবাহিত হয়।’

সিলেটের গোয়াইনঘাটের সহকারি কমিশনার (ভূমি) একেএম নূর হোসেন প্রথম খবরকে বলেন, ‘মারী নামে কোনও নদী তো পাওয়া যায়নি। মারী নদী নামে কোনও নদীর অস্তিত্ব নেই। ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী এক সময়ের হাইড় নামক নদীটিই এখন সারি নদী নামে পরিচিত।’

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পিন্টু কানুনগোয় প্রথম খবরকে বলেন, ‘সারি (saree) নামক নদীটির অবস্থান জৈন্তাপুরে। এটি জাফলং থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান। কিন্তু মারী নামক কোনো নদী নেই।’

প্রতিবছরই প্রাথমিকের অন্যান্য বইগুলোর মতো চতুর্থ শ্রেণির এই বইটিও এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসানের কাছে এসেছিলো। কিন্তু তিনিও এ বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না।

ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম খবরকে  বলেন, ‘প্রতিবছরই বই পরিমার্জিত হয়। বিশেষ করে বানান কিংবা তথ্যের বড় ধরনের ভুল থাকলে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পরিমার্জন করা হয়। তবে জাফলংয়ের তথ্যের ভুলের এ বিষয়টি জানা নেই। এ বিষয়ে বলতে গেলে লেখকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

বানান ও ভাষাগত দিক ঠিক করার পাশাপাশি তথ্যগত উপস্থাপনা কীভাবে হচ্ছে, উপযুক্ত ছবিসহ বিভিন্ন বিষয় দেখে সম্পাদনা বিভাগ। কিন্তু এত বছরে তাদের চোখেও পড়েনি বিষয়টি।

এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার ঢালী প্রথম খবরকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি এখানে। আমার আসার পরেও বইটি পরিমার্জিত হয়ে গেছে কিন্তু এই ভুলটা চোখে পড়েনি। বই সম্পাদনার জন্য যে সময় বেঁধে দেওয়া হয় সেটা খুব অল্প। ফলে অনেক সময় উৎসে ভুল থাকে সেগুলো দেখা অনেক সময় হয়ে উঠে না তাড়াহুড়োর কারণে।’

অর্থাৎ এনসিটিবির তাড়াহুড়োজনিত ভুলের প্রভাব কোমলমতি শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও জানা যায় এনসিটিবিতে বই সম্পাদনার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র সাহা প্রথম খবরকে বলেন, ‘বই যাতে নির্ভুল হয় সে বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকে। তারপরও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়। প্রাথমিকের চতুর্থ শ্রেণির বইয়ের এই তথ্যটি সঠিকভাবে উপস্থাপনের বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে দেখবো।’

এদিকে শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষাবিদ ড. একরামুল কবির প্রথম খবরকে বলেন, ‘শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক তৈরি আলাদা প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। অর্থাৎ শিক্ষাক্রম থেকে যখন বলা হবে এর আলোকে বই তৈরি করো তখন পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সেই বই তৈরির কাজে মনোনিবেশ করবে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাক্রম তৈরি করার পাশাপাশি বই লেখা এবং ছাপার কাজও করতে হয় একই প্রতিষ্ঠানকে। ফলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়ে গেছে। কারণ কোনটাই ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না।

এনসিটিবিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বড় পরিবর্তন দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অর্থাৎ এখানে নিয়োগের সময় কর্মকর্তাকে তার পদের অর্থাৎ কাজের বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিজ্ঞ করে তুলতে হবে। এর আগে কোনোভাবেই তাকে সেই পদের কোনও কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ পাঠ্যবই খুবই স্পর্শকাতর একটা বিষয়। একটা প্রজন্ম তৈরি হয় তাদের হাতে।’

বই প্রণয়ন ও প্রস্তুত ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাবা উচিত বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষাবিদ।

Share this post

PinIt

Leave a Reply

Your email address will not be published.

scroll to top