“…বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে।”
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের গান পড়ে অনেক যুবক হয়তো মুচকি হাসে। হাসির পেছনে থাকে নিজের তারুণ্যের ওপর অগাধ বিশ্বাস। আর নজরুলের সেই বৃদ্ধও আশেপাশে সহসা আবিষ্কার হয় না। যে উদাহরণের দৃষ্টান্ত কম তা যত বড় গুণীরই হোক না কেন সহজে গ্রহণ করার মানসিকতা সবার হয় না। তরুণরাতো তুরি মেরে সব উড়িয়ে দিতে চায়। যে কথা কিংবা বাণী তারুণ্যের বিরুদ্ধে যায় তাকে-তো পরোয়াই করে না।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। সেখানে স্বপ্নই যদি দিন দিন ছোট হয়ে আসে তাহলে? এর জন্যই তিনি মানুষকে বইয়ের জগৎটা চেনানোর জন্য জীবনভর সাধনা করেছেন এখনও করে যাচ্ছেন। গ্রন্থের ভূবন অবারিত স্বপ্নের ভূবন। স্বপ্নবান মানুষ তৈরিই তার ব্রত।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টান্তের সেই তারুণ্যের বাস্তব উদাহরণ। এক জীবন যিনি পার করছেন একটা জাতিকে বই পড়ানোর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। আলোকিত মানুষের সন্ধানে যার অনুসন্ধিৎসু মন সদাই তৎপর। যুগের হাওয়ায় কত রীতিইতো বদলে গেছে। এখন আর পরিবারে কিংবা সমাজে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে পারেন কিংবা করেন এমন মানুষ নেই। একবিংশ শতাব্দীতে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা বিনোদনের জন্য আর গল্প শোনে না। ঠাকুরমার ঝুলির মুখ বন্ধ, আরব্য রজনী, আলীবাবা চল্লিশ চোর কিংবা সোনার কাঠি-রুপার কাঠির পঙ্খীরাজের সেই রাজকুমার এখন চোখের সামনে টিভির পর্দায় হয়তো দেখা যায় কিন্তু মনের চোখ দিয়ে কল্পনা করার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাই হয়তো শিশুর স্বপ্নের আকারও বড় হয় না। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। সেখানে স্বপ্নই যদি দিন দিন ছোট হয়ে আসে তাহলে? এর জন্যই তিনি মানুষকে বইয়ের জগৎটা চেনানোর জন্য জীবনভর সাধনা করেছেন এখনও করে যাচ্ছেন। গ্রন্থের ভুবন অবারিত স্বপ্নের ভুবন। স্বপ্নবান মানুষ তৈরিই তার ব্রত।
‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। আমরা সবকিছুর একটা তড়িৎ ফল চাই। সন্তান বড় হলে বছর বছর তার ভালো রেজাল্ট চাই, রেজাল্ট ভালো হলে ভালো একটা চাকরি চাই! তাও আবার কেমন চাকরি; যে মানুষেরা গুগল কিংবা ফেসবুক বানিয়েছেন তাদের প্রতিষ্ঠানে একটা চাকরি। আমার সন্তানও গুগল ফেসবুকের মতো কিছু একটা তৈরি করে সময় নষ্ট করুক এটা চাই না! যাহোক গুগল-ফেসবুকে চাকরি করতে চাওয়ার স্বপ্নটাও এখন অনেক বড় মনে হয়। ওইসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে যেসব যোগ্যতা লাগে তাওতো কম নয়। আমরা আরও সহজ কিছু চাই, আমার সন্তান বই মুখস্ত করে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হোক। সমাজে আমার একটা প্রভাব-প্রতিপত্তি হোক। চায়ের দোকানে চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে সেই গল্প করলেই আমার সুখ! তাই বলে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের সমাজে চাকরির প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছি না। বলতে চাচ্ছি আমাদের স্বপ্নই আজ সীমাবদ্ধ! বাস্তবিক প্রয়োজন পূরণের পরও আমরা সেই সংকীর্ণতার গণ্ডি থেকে বের হতে পারছি না।
‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান দেয়ার দীর্ঘদিন পরেও যিনি দেখছেন ‘আলোকিত মানুষ নাই’। স্বার্থান্ধ আর স্বার্থপরতার গাঢ় অন্ধকারে কোনো কিছুই যেখানে ভালো করে দাঁড়াতে পারে না সেখানে তিনি আলোর মশাল জ্বেলে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানকে।
এইদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটা সবাই অকপটে স্বীকার করি। কিন্তু কয়জন তার সন্তানকে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা বানাতে চাই! আমরা বরং বঙ্গবন্ধু কত সালে চীন গিয়েছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তরে টিক চিহ্ন দিয়ে কিংবা ‘খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখে বরং একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারলেই বেঁচে যাই। যারা অন্য কোনো নেতার আদর্শ ধারণ করেন বলে জানান দেন তাদেরও বেশিরভাগের ক্ষেত্রে একই দশা!
এমন একটি সমাজের মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়ে তাকে তার স্বপ্নের সমান বড় করার চেষ্টায় নিয়োজিত ব্যক্তিই আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান দেয়ার দীর্ঘদিন পরেও যিনি দেখছেন ‘আলোকিত মানুষ নাই’। স্বার্থান্ধ আর স্বার্থপরতার গাঢ় অন্ধকারে কোনো কিছুই যেখানে ভালো করে দাঁড়াতে পারে না সেখানে তিনি আলোর মশাল জ্বেলে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানকে। হয়তোবা দেশের কোনো এক প্রান্ত থেকে একদিন সেই আলোকিত মানুষের দেখা মিলবে যে কখনও আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের সাক্ষাতও পায়নি! কিন্তু ছোঁয়া পেয়েছে তার বইপড়া কর্মসূচির। হয়তোবা বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে কোনোদিন আসেনি। গ্রামের কোনো এক প্রান্তে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কিংবা স্কুলে গড়ে ওঠা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পাঠাগারের সান্নিধ্যে এসেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা কিংবা মক্তব যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকেই তার আবির্ভাব ঘটতে পারে। নারী কিংবা পুরুষ যে কেউ হতে পারে। সুনিপুণ স্পর্শে জ্বলে ওঠা একজন আলোকিত মানুষই একটি জাতির জন্য যথেষ্ট।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের তারুণ্য এখনও অটুট। তিনি যখন আশিতে সবেমাত্র পদার্পণ করলেন সেই সময় একদিন ড্রাইভিং সিটে বসে তাকে গাড়ি চালাতে দেখেছি। করোনা তখনও বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েনি এমন একদিন ২০২০ সালের মার্চ মাসে স্যারসহ একটা দল আমরা গেলাম রমনায় গাছ-ফুল ও নিসর্গ চিনতে। সেদিন রমনায় স্যার যেন দৌড়াচ্ছিলেন আর আমরা তার পেছনে পেছনে হাঁটছিলাম! আমরা অল্পবয়সীরা হাঁপিয়ে উঠছি আর স্যার ছুটেই চলছিলেন। এই হলো তারুণ্য।
এরপর করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলো বিশ্বসাহিত্য পাঠচক্র কিছুদিন থমকে থাকলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই ডিজিটাল প্লাটফরমে তা চালু হলো। চিরতরুণ স্যার জুমেও নিজেকে মানিয়ে নিলেন সাবলীলভাবে। স্যারকে এখন পর্যন্ত পাঠচক্র, উচ্চতর পাঠচক্র এবং নানাবিধ আলোচনা অনুষ্ঠানে সরব থাকতে দেখা যায়। মজার বিষয় স্যারের সেই চিরায়ত স্বভাব পাঠচক্রের জন্য যে নির্ধারিত বই থাকে সে বইটা পড়েই তিনি প্রতিনিয়ত হাজির থাকেন। কালেভাদ্রে পড়তে না পারলে নিজে থেকেই জানিয়ে দেন। মাঝে মাঝেতো হাসির ছলে বলেন, ‘দীর্ঘ জীবন লাভের এই একটা বিড়ম্বনা এক বই বার বার পড়তে হয়।’ স্যারের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী করোনাকালে তিনি প্রতি সপ্তাহে তিনটা বই রুটিন করে পড়েন তা হলো বিশ্বসাহিত্য পাঠচক্র ও উচ্চতর পাঠচক্রের বই। এটাকে ক্লাসের পড়াই বলায় যায়! সেইসঙ্গে নিজের লেখা বই। নিজের লেখা বই তিনি পড়েন সেগুলোকে পুনরায় এডিট করার জন্য। ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ এর মতো বই নাকি তিনি এমনভাবে এডিট করেছেন যে তার মধ্যে পুরনো পাঠকও নতুনত্ব পায়।
তবে করোনাকালে তার ডিজিটাল সান্নিধ্য পাওয়া শিক্ষার্থীদের একটা লোভ সংবরণ হয়েছে সফলভাবে তা হলো স্যারের রিডিং টেবিলের দেখা পাওয়া। কারণ ওই টেবিলে বসেই জুম মিটিংয়ে মিলিত হন তিনি। দুইপাশে সারি সারি বই, মাঝখানে আলোর ফেরিওয়ালা। বিড়ম্বনাও আছে! আগে স্যারকে ফাঁকি দেওয়া যেত পাঠচক্রের নির্ধারিত বইয়ের ওপর আলোচনা না করে। এখন স্যার মাঝে মাঝে জুমে প্রদর্শিত নাম ধরে ডাক দেন। দেরি করে বসলে সহজেই বুঝে ফেলেন। জুমের জামানার আগে পেছনের চেয়ারগুলোতে বসে সহজেই যা এড়ানো যেত!
করোনাকালেই আমাদের উচ্চতর পাঠচক্রের রেশমা নাহার রত্না সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। সেদিন শুক্রবার ছিল, জুমে উচ্চতর পাঠচক্র চলছিল। এমন সময় রত্নার মৃত্যুর খবর আসে। হাসিখুশি পাঠচক্রে যেন শোকের মাতম শুরু হয়। সেই সময়টা আমরা চরম বেদনায় মুষড়ে পড়েছিলাম। স্যারকেও দেখেছি সমব্যথী হতে। পরের সপ্তাহে স্যার আমাদের সান্ত্বনা দেন। তার সান্ত্বনা বাণীই ছিল, ‘বেঁচে থাকলে প্রিয়বিয়োগ সইতে হয়’। তখন বুঝেছি লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সবার জন্য স্যারের হৃদয়ে আছে সমান মমতা। প্রতিটি ফুল ফুটুক আর সুগন্ধ ছড়াক মনে মনে এই প্রত্যাশাকেই লালন করেন তিনি। ফুল ফোটার আগেই ঝরে পড়লে অনেক কষ্ট পান।
এভাবেই একটা কর্মময় জীবন পার করছেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। আজ তার জন্মদিন। ৮২ বছর বয়সী এই মানুষটির কর্মব্যস্ততা দেখলে মনে হয় ২৮ বছরের কোনো যুবক। চির তরুণ এই মানুষটির জন্য নিরন্তর শুভ কামনা।