একদা যে কলেজে অধ্যয়ন করা গৌরবের ও সম্মানের মনে হতো! ঐতিহ্যবাহী এই কলেজকে একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে গণ্য করা হতো! তবে, সত্যিকার অক্সফোর্ড না হলেও মানুষের অন্তরে এর আবেদন কোনোভাবেই কম ছিলো না!
অত্রাঞ্চলের অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী সবার কাছেই মনে হতো এখানে ভর্তি হতে পারলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সামিল! ১৯৪৯ সালে দানবীর ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের স্থাপিত দৃষ্টিনন্দন কলেজ ভবনটি শুধুই শিক্ষার্থী নয়, ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছেও বেশ প্রিয়!
শুধু তাই নয়, এমন অজপাড়াগায়ে শুরু থেকেই এতোটা সমৃদ্ধ মহাবিদ্যালয় দেশে খুব বিরল। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যে সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরি, শিক্ষকদের জন্যে ডরমিটরি, ছাত্রদের জন্যে বিশাল ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক ভবন, অধ্যক্ষ বাংলো, বিশাল খেলার মাঠ এবং ব্রিটানিকা ও এনসাইক্লোপিডিয়া সহ কয়েক হাজার বইয়ের বিশাল গ্রন্থাগারসহ আরও অনেক সুযোগসুবিধা।
শুরু থেকেই উপমহাদেশের সবচে ভালো ফলাফল করা শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো এখানে। আর তাই ভালো ফলাফলের তালিকায় নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছিলো এই কলেজের শিক্ষার্থীরা। অবিভক্ত ভারত ও পাকিস্তান মিলে সেরার তালিকায় ছিলো কয়েকবার। এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থী ভালো ফলাফলে এবং কর্মজীবনে নিজের মেধায় দেশকে করেছেন আলোকিত।
শুধুইকি শিক্ষায়? এই কলেজে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও যেন যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে কোনো অংশে কম ছিলো না। শক্তিশালী ছাত্র সংসদও ছিলো যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর মতোই!
স্থানীয় রাজনীতি অনেকটাই নির্ভর করতো এই কলেজের ছাত্রসংসদের উপর। কলেজ ক্যাম্পাস সরগরম থাকতো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। দেশের বেশ কজন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এই কলেজে এসেছিলেন।
কলেজ প্রতিষ্ঠাতা দানবীর ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সারাজীবনের অর্জিত অর্থ দাতব্য খাতে ব্যয় করে গেছেন। তাঁর বড় ভাই কামিনী কুমার দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী। অবিভক্ত ভারতের আইন ও শিক্ষামন্ত্রী। দুই ভাই কুমিল্লায় অভয় আশ্রম মৃণালিনী ছাত্রীনিবাস সহ অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত ভারতে প্রতিষ্ঠা করেন বেংগল ইমিউনিটি ঔষধ কারখানা এবং যুগান্তর পত্রিকা।
কালের বিবর্তনে আমার প্রিয় সেই কলেজটির সামনে এখন নতুন করে শুধুমাত্র সরকারী কথাটি যুক্ত হলেও হারিয়েছে আগের সেই জৌলুশ! আমাদের সময় কিংবা তারও আগের ছাত্ররা বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শ্যমাপ্রসাদ ভট্টাচার্য স্যারের লেকচার শুনতে উপরের শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও নীচের ক্লাসে বসে থাকতেন।
আহা কি প্রাণবন্ত লেকচার! অনেক মিস করি! যদিও এতো ভালোর মাঝেও স্যারের সাথে জীবনের একটি কষ্টের স্মৃতি জড়িয়ে আছে! সবকিছু ছাপিয়ে সময়ের ব্যবধানে স্যার এখন আমার গড়া সংগঠন ঐতিহ্য কুমিল্লার উপদেষ্টা।
দুই যুগেরও বেশি সময় আগে ছেড়ে আসা প্রিয় কলেজের ক্যাম্পাসে যেন আজ ভুতুড়ে পরিবেশ! কাছে গিয়ে যখন শুনশান নীরবতায় আচ্ছন্ন দেখতে পাই, তখন নিজের কাছে বেশ পীড়াদায়ক মনে হয়।
পুনশ্চ: লিখাটি আসলে হাটতে হাটতেই লিখা। খুব বেশি ভাবনার ফসল নয়। তারপরও একটা কথা না বললেই নয়, অনেকেই একটা বিষয় ভুল করছেন। প্রতিষ্ঠা কাল এবং ভবন স্থাপনের সন নিয়ে। লক্ষ্য করে দেখবেন, আমি কিন্তু ভবন স্থাপনের কথা উল্লেখ করেছি, প্রতিষ্ঠাকাল না। ১৯৩৯ সালে তিনি নিজ গ্রাম শ্রীকাইলে তার পিতার নামে ‘কৃষ্ণ কুমার উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীকাইল কলেজ। ১৯৪৯ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ হয়।
(নোট: ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার জনাব খলিলুর রহমান এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে ফেরার পথে শ্রীকাইল বাজার অতিক্রমের সময় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয় শ্রীকাইল কলেজ ক্যাম্পাসটি দেখে যাবার। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি। এসময় আমরা যারা ছিলাম- পায়রা বন্দরের পরিচালক (উপ-সচীব) ড. আতিকুল ইসলাম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান, ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের ব্যবস্থাপনক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সিপন মিয়া, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাকির হোসেন, কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ও জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সদস্য মাহবুবুল আলম চপল, ইতালির সিসিলি প্রদেশ আওয়ামীলীগ সভাপতি জাহিদ খান মিহির, ঐতিহ্য কুমিল্লা সংগঠনটির পরিচালক ও গণমাধ্যমকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল এবং তরিকুল ইসলাম তরুন।)
ছবিটি আজ ৪ জুন ২০২১ বিকেলে তোলা।
জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল।।
ঐতিহ্য কুমিল্লা।।