বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনঃ আফগানিস্তান থেকে এরই মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মার্কিন সৈন্য। আমেরিকা জানিয়েছে, দেশটি ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ সেনা সরিয়ে নিয়েছে। বাকি সৈন্য খুব শিগগিরই সরিয়ে নেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, দেশটি থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সৈন্যও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সৈন্য পুরোপুরি প্রত্যাহারের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই ঝড়ের গতিতে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে তালেবান। দেশটির কমপক্ষে ৭০ শতাংশ এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করছে তালেবান, যা খুব শক্ত গলায় প্রত্যাখ্যান করতে পারছে না আফগান সরকার।
এদিকে, তালেবান আবারও আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করবে এই সম্ভাবনায় অন্য অনেক দেশই উদ্বিগ্ন, তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছে সম্ভবত ভারত।
“অনেক দেশই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু অন্য যেকোনও দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ এখন ভারতের। তালেবান আবার ক্ষমতা নিলে ভারতের ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি,” বলছিলেন ড. সঞ্জয় ভরদোয়াজ, যিনি দিল্লির জওহারলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক।
তিনি বলেন, “ভারতের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে ভারত এখন জটিল এক সংকটে পড়েছে।”
বিশ বছর আগে ২০০১ সালে আমেরিকার সামরিক অভিযানে ক্ষমতা থেকে তালেবান উৎখাত হওয়ার পর যে দেশটি আফগানিস্তানে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে সবচেয়ে তৎপর হয়েছিল, সেটি ভারত।
আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে গত দুই দশকে চারশ’রও বেশি সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও, দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিমি দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে ভারত। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনটিও তৈরি করেছে তারা।
চলমান শত শত প্রকল্পের এখন কী হবে? যে উদ্দেশ্যে এসব বিনিয়োগ, তার ভবিষ্যৎ কী? এগুলো কি পানিতে যাবে? ভারতের নীতি-নির্ধারকরা সে চিন্তায় এখন অস্থির।
আফগানিস্তানকে কেন দরকার ভারতের?
শুধু ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের বিষয়টির জন্যই নয়, বরং ড. ভরদোয়াজের মতে আরও অনেক কারণে ভারতের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব রয়েছে।
“বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অভিলাষ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ভারতের জন্য আফগানিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ,” তিনি বলেন।
মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢোকার জন্য ভারতের জন্য আফগানিস্তান খুবই জরুরি। আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ইরান ও মধ্য এশিয়ার সাথে দুটো পাইপলাইন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এসবের চেয়েও বেশি।
ড. ভরদোয়াজ বলেন, “কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে এবং লাদাখ নিয়ে চীনের সাথে বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব রয়েছে ভারতের। এখন আফগানিস্তান শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হলে ভারতের জন্য তা বড়রকম মাথাব্যথা তৈরি হবে।
“অতীতে আফগানিস্তান থেকে মুজাহিদীনরা এসে কাশ্মীরে তৎপর হয়েছে। তালেবান ক্ষমতায় এলে বা তাদের প্রভাব বাড়লে তার পুনরাবৃত্তি হয় কিনা, সে ভয় ভারতের মধ্যে প্রবল।”
“তবে ভারতের সবচেয়ে বড় চিন্তা পাকিস্তান,” আরও যোগ করেন তিনি। “পাকিস্তান যদি আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা নীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, তা হবে ভারতের জন্য দুঃস্বপ্ন।”
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকরের ছোটাছুটি
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর পশ্চিম এশিয়া চষে বেড়াচ্ছেন মূলত এসব শঙ্কা থেকেই। গত মাসে তিনি দু’বার দোহায় গেছেন। গত সপ্তাহে মস্কো যাওয়ার পথ তেহরানে নামেন তিনি।
মজার ব্যাপার হলো, তিনি যখন ওইসব রাজধানীতে গেছেন তখন সেখানে তালেবানের নেতারা ছিলেন।
প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি কাকতালীয়? নাকি পরিকল্পনার অংশ?
তালেবানের সাথে কোনও মীমাংসা নয়’- প্রকাশ্যে এই নীতি নিলেও ভারত সরকার হালে তালেবানের সাথে তলে তলে যোগাযোগ করার জোর চেষ্টা করছে, এমন কানাঘুষো দিনকে দিন বাড়ছে।
পাকিস্তানের সাংবাদিক সামি ইউসুফজাই, যার সাথে তালেবানের নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, ২৯ জুন এক টুইট করেন- “আফগান তালেবান সূত্র নিশ্চিত করেছে এস জয়শংকর এবং তালেবান নেতা মুল্লা বারাদার ও খায়রুল্লাহ শেখ দিলওয়ারের সাথে বৈঠক হয়েছে, যেখানে তালেবান নেতারা তাকে ভরসা দিয়েছেন যে ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক পাকিস্তানের ইচ্ছামত হবে না।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এক বিবৃতিতে বলেছে যে তালেবানের সাথে এরকম কোনও বৈঠক হয়নি, এসব খবর বানোয়াট।
তবে ড. ভরদোয়াজ বলেন যে তালেবানের সাথে বোঝাপড়ার উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া ভারতের সামনে এখন তেমন কোনও বিকল্প নেই।
“পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কথা-বার্তা, বক্তৃতা থেকে আমি যা বুঝতে পারছি তাহলো, ভারত অনুধাবন করছে তালেবানকে অবজ্ঞা বা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তবে তালেবানের যা ইতিহাস-আদর্শ, তাতে তাদের সাথে কথা বলা হবে ভারতের জন্য বড় ধরণের বিড়ম্বনা।”
ভারত বিশ্বাস করে তালেবানের ক্ষমতাকালে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান অপহরণ করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার সাথে পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-য়ের সাথে তালেবানও সম্পৃক্ত ছিল।
এরপর ২০০৮ সালে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে হামলা – যাতে ৫৮ জন নিহত হয়– তার পেছনেও তালেবানের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হাক্কানি নেটওয়ার্কের হাত ছিল বলে ভারত নিশ্চিত। ২০১৪ সালের ২৩ মে হেরাতে ভারতীয় কনস্যুলেটে হামলার পেছনেও হাক্কানি নেটওয়ার্কের হাত ছিল বলে ভারত মনে করে।
এই যখন ইতিহাস তখন তালেবানের সাথে আপোষ-মীমাংসা নিয়ে ভারত কতটা ভরসা করতে পারে?
আফগানিস্তানে তালেবান কি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার?
লন্ডনে সোয়াস ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসির গবেষক এবং পাকিস্তান রাজনীতির বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন যে পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে তালেবানের সাথে কোনও বোঝাপড়া করা ভারতের জন্য অত্যন্ত দুরূহ কাজ হবে।
“ভারত তলে তলে বছর দুয়েক ধরেই তালেবানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। সেই সাথে পাকিস্তানও চেষ্টা করছে সেই সম্পর্ক যাতে না হয়।”
ড. আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, তালেবানের ওপর ভরসা করা ভারতের জন্য কঠিন কারণ, তার মতে, “তালেবানের মধ্যে পাকিস্তানের প্রভাব অনেক গভীর।”
তিনি বলেন, পাকিস্তান এখনও তালেবানকে এতটাই নিয়ন্ত্রণ করে যে দোহায় যখন আমেরিকানদের সাথে তালেবানের আপোষ-মীমাংসা চলেছে, তখন কাতারে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে তালেবানকে প্রতি মুহূর্তে গাইড করা হতো।
“কখন কী কথা বলতে হবে, কোন দাবি তুলতে হবে, কোন দাবি প্রত্যাখ্যান করতে হবে– প্রতিটি পদক্ষেপে দোহায় পাকিস্তান দূতাবাস থেকে তালেবান নেতাদের কানে পরামর্শ পৌঁছে দেওয়া হতো।”
তাছাড়া, ড সিদ্দিকা বলেন, দোহাভিত্তিক যেসব তালেবান নেতার সাথে ভারত কথা বলছে বলে জানা যায়, আফগানিস্তানের ভেতরের পরিস্থিতির ওপর তাদের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
“দোহায় যারা আছেন তারা তালেবানের বুদ্ধিজীবী অংশ, তারা কিছুটা উদারপন্থী। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন।”